মো. নুরুল করিম আরমান |
বান্দরবান জেলার লামা উপজেলায় একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জায়গার উপর নির্মিত ১৩টি দোকানের মধ্যে ১২টিই দীর্ঘ ৩৩ বছর ধরে জবরদখলে রাখার অভিযোগ উঠেছে। পতিত আওয়ামী লীগ সরকার সমর্থিত প্রভাবশালী ব্যক্তিরা উপজেলার শিল্পনগরী আজিজনগর ইউনিয়নের স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চাম্বি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দোকান প্লট জবরদখল করে রাখেন। এ নিয়ে সাবেক প্রধান শিক্ষক ও বর্তমান প্রধান শিক্ষক আদালতে মামলাসহ ৪২বার আবেদন করেও দোকান প্লট উদ্ধার করতে পারেননি। দীর্ঘ বছরেও দোকান প্লট উদ্ধার না হওয়ায় বিদ্যালয়ের শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। বিদ্যালয়ের দোকান প্লট উদ্ধারে প্রশাসনের প্রতি জোর দাবীও জানান তারা।
জানা যায়, ১৯৬০ সালে উপজেলার চাম্বি মৌজার ১৮নং খতিয়ানের ১৯২ ও ১৯৩নং দাগের আন্দর ৯৮ শতক জায়গার উপর চাম্বি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি প্রতিষ্টিত হয়। ইউনিয়নটি শিল্পনগরী হওয়ায় বিদ্যালয়টির গুরুত্ব রযেছে অনেক। বর্তমানে এ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা ৭৩২ জন। দিন দিন শিক্ষার্থী সংখ্যা বেড়ে চলেছে। অভিযোগ উঠেছে, ১৯৯২সালে ইকবাল আহছান বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক থাকাকালীন সর্বপ্রথম পশ্চিম কর্নারে একটি দোকান প্লট দখল করেন এইচ এম আবু জাহাঙ্গীর চৌধুরী। এরপর তিনি একে একে আরও তিনটি দোকান প্লট দখলে নেন। এ ঘটনায় তৎকালীন প্রধান শিক্ষক ইকবাল আহছান জবর দখলকারী এইচ এম আবু জাহাঙ্গীর চৌধুরীর বিরুদ্ধে আদালতে মামলাও করেন। এ প্রেক্ষিতে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে কয়েক মাস ভাড়া প্রদান করলেও পরবর্তী এইচ এম আবু জাহাঙ্গীর ভাড়া পরিশোধ না করে জবর দখল করে রাখেন। এইচ এম আবু জাহাঙ্গীর চৌধুরী বাংলাদেশ আওয়ামী মটর চালক লীগের বান্দরবান জেলা শাখার সভাপতি, উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ন সাধারন সম্পাদক ও আজিজনগর ইউনিয়ন পরিষদর সাবেক চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিনের ভগ্নিপতিও। তার দেখাদেখি একই বছর ইসহাক ভূইয়া ২টি, জাকারিয়া ১টি, আব্দুল লতিফ ২টি, লকিয়ত উল্লাহ ২টি, মো. রফিক ১টি প্লট দখলে নিলেও পরবর্তীতে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাথে ভাড়া ছুক্তি করেন। এসব দোকান প্লটের মধ্যে একটি প্লটের ভাড়াটিয়া কামাল হোসেন বর্তমান পর্যন্ত বিদ্যালয়কে রীতিমত ভাড়া পরিশোধন করে আসছেন। অন্যরা বিদ্যালয়কে ভাড়া না দিয়ে কেউ কেউ এসব দোকান উপ-ভাড়া দিয়ে প্রতিমাসে নিয়মিত টাকা নিচ্ছেন।
বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সাবেক সদস্য আবুল খায়ের ও আবু ছালেহ, ছাত্র অভিভাবক সেলিম উদ্দিন, কামরুল ইসলাম কাননসহ অনেকে জানান, আজিজনগর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি থাকাকালীন নিজের মর্জিমত নামমাত্র ভাড়ায় তার ভগ্নিপতি জাহাঙ্গীরকে ৪টি দোকান ভাড়া দেখান। যাতে প্রধান শিক্ষক স্বাক্ষর করেননি। ভাড়া চুক্তি করলেও তিনি কয়েকমাস ভাড়া দিলেও পরবর্তীতে বিদ্যালয়কে ভাড়া দেননি। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর মো. জসিম উদ্দিন পলাতক হলেও বিদ্যালয়ের জমি উদ্ধার হয়নি। আমরা প্রশাসনের নিকট বিদ্যালয়ের দোকান প্লট দ্রুত উদ্ধারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবাী জানাচ্ছি।
এদিকে দোকান প্লট উদ্ধারে প্রধান শিক্ষকের লিখিত আবেদনর প্রেক্ষিতে লামা উপজেলা নির্বাহী অফিসার উপজেলা পরিসংখ্যান কর্মকর্তাকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। পরিসংখ্যান কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম জানায়, ‘সরেজমিনে বিদ্যালয়ের জবরদখলের তদন্তকাজ শেষ করেছি। তাতে জবর দখলের সত্যতা মিলেছে। ইমিধ্যে তদন্ত রিপোর্ট উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে জমাও দিয়েছি।
বিদ্যালয়ের দোকান প্লট ভাড়াটিয়া কামাল হোসেন বলেন, আমি বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ থেকে দোকান ভাড়া নিয়েছি। রীতিমত ভাড়াও পরিশোধ করে আসছি। তবে দোকান জবরদখলকারী আব্দুল লতিফ সওদাগর বলেন, বহু বছর বিদ্যালয়কে ভাড়া দিয়েছি। অপর ভাড়াটিয়া এইচ এম আবু জাহাঙ্গীর চৌধুরী ভাড়া দেয়না, তাই এখন আমরাও দিচ্ছিনা। তবে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চাইলে ভাড়া দিতে প্রস্তুত আছেন বলে জানান, অপর দোকান প্লট দখলকারী আব্দুল মোতালেব। দোকান জবর দখলকারী এইচ এম আবু জাহাঙ্গীর চৌধুরী জানায়, আগে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে চুক্তি মতে দোকান প্লটের ভাড়া পরিশোধ করেছি। কিন্তু এখন দোকানের জায়গা সড়ক ও জনপথ বিভাগ দাবী করার কারনে বিদ্যালয়কে ভাড়া দিচ্ছিনা।
বিদ্যালয়ের দোকান প্লট জবর দখলের সত্যতা নিশ্চিত করে প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন জানিয়েছেন, ‘বিদ্যালয়ের প্রায় ৩০ শতক জমি দখলদারদের হাতে। তাঁরা দোকান তৈরি করে তাতে ব্যবসা করছেন। বিদ্যালয়ের জায়গায় অবৈধভাবে দোকান নির্মাণ এবং দখলদারদের উচ্ছেদে সাবেক প্রধান শিক্ষকরা, বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি এবং আমি (বর্তমান প্রধান শিক্ষক) সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও আদালতসহ বিভিন্ন দপ্তরে ৪২টি চিঠিপত্র প্রেরণ করেছি। কোন সুরাহা হয়নি। এখনো দোকান প্লট জবর দখল করে রেখেছেন প্রভাবশালীরা।
তবে লামা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা দেবাশীষ বিশ্বাস জানান, বিদ্যালয়ের দোকান প্লট জবর দখল বিষয়টি নিয়ে আমার চেয়ে বড় বড় লোক মাথা ঘামাচ্ছেন। জেলা পরিষদের মাসিক মিটিংয়েও এই বিষয়টি উঠেছে। তবুও সুরাহা হয়নি।
এ বিষয়ে লামা উপজেলার নির্বাহী অফিসার মো. মঈন উদ্দিন জানান, তদন্ত রিপোর্টে চাম্বি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জায়গা উপর নির্মিত দোকান প্লট জবরদখলের সত্যতা পাওয়া গেছে। জেলা প্রশাসকের অনুমতিক্রমে বিধি মোতাবেক জমি উদ্ধারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। #