
সবুজাভ পার্বত্য চট্টগ্রাম। দেশের এক দশমাংশ ভূখন্ড। এই জনপদ এক স্বপ্ন আর সংগ্রামের ভূমি। যেখানে একসময় মুক্তির গান রচিত হয়েছিল, আজ সেই ভূমিতেই রচিত হচ্ছে এক নতুন বঞ্চনার মহাকাব্য। ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তি- যা পাহাড়ে দীর্ঘদিনের সংঘাতের যবনিকা টানার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল- কালের পরিক্রমায় তা এক বিশেষ জনগোষ্ঠীর জন্য সুরক্ষার কবচ হলেও, এই অঞ্চলের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী, অর্থাৎ বাঙালিরা, নিজেদের জন্য একে বঞ্চনার এক পদ্ধতিগত দলিল হিসেবে দেখছে। সংবিধানের পবিত্র ছায়াতলে দাঁড়িয়েও জাতিসত্তার সমতা ও রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধার ন্যায্য হিস্যা থেকে তারা আজ বহু দূরে। এই নিগ্রহের ইতিকথা শুরু হয় আত্মপরিচয় হরণের মতো মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে, যা রাষ্ট্রীয় আইনের জটিল আবর্তে ক্রমাগত গভীর হয়েছে।
শান্তিচুক্তির পর রাজনীতির রূপান্তর:
১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তি পার্বত্য রাজনীতিতে নতুন দিগন্ত খুলবে-এমন আশা ছিল। কিন্তু বাস্তবতা উল্টো। শান্তিচুক্তি পরবর্তী রাজনীতি গণমানুষের চেয়ে বেশি কেন্দ্রিত হয়েছে নেতৃত্বের হাতে। স্থানীয় সরকারের বিকেন্দ্রীকরণের পরিবর্তে ক্ষমতা সঙ্কুচিত হয়েছে কিছু ব্যক্তি ও দলের মধ্যে। এখন পাহাড়ে রাজনীতি মানে আনুগত্য, আদর্শ নয়। মতভেদ মানে বিদ্রোহ, প্রশ্ন মানে শত্রুতা। গণতান্ত্রিক চেতনার বদলে বেড়ে উঠেছে দমননীতি, ভীতি ও অবিশ্বাসের সংস্কৃতি।
আত্মপরিচয় হরণের বেদনা; ‘বাঙালি’ থেকে ‘অ-উপজাতীয়’:
বাংলাদেশের সংবিধান তার সকল নাগরিককে জাতি হিসেবে বাঙালি (অনুচ্ছেদ ৬) হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই জাতীয় পরিচয় যেখানে একজন নাগরিকের অহংকার ও জন্মগত অধিকার, সেখানে পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন এবং শান্তিচুক্তির প্রয়োগে বাঙালির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে ‘অ-উপজাতীয়’ (Non-Tribal) নামক এক নেতিবাচক পরিচয়। এটি কেবল একটি প্রশাসনিক বিভাজন নয়; এটি সাংবিধানিক স্বীকৃতির প্রতি এক নির্লজ্জ বিচ্যুতি এবং আত্মপরিচয়গত নিগ্রহের শামিল।
যখন দেশের সর্বোচ্চ আইন একজন নাগরিককে একটি পরিচয় দেয়, আর স্থানীয় বিশেষ আইন তাকে সেই পরিচয় থেকে বঞ্চিত করে একটি ‘অন্য’ হিসেবে চিহ্নিত করে, তখন তার বঞ্চনা শুরু হয় মনস্তাত্ত্বিকভাবে। এটি যেন নাগরিক সত্তাকে খণ্ডিত করার এক সুদূরপ্রসারী কৌশল-যা রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে বাঙালির দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে অবস্থানকে বৈধতা দেয়।
সংবিধান ও জাতিসত্তা; পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘আদিবাসী’ দাবির সাংবিধানিক ভিত্তি:
বাংলাদেশের সংবিধানে দেশের সকল নাগরিকের পরিচয় ও অধিকার স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা আছে। সংবিধান অনুযায়ী, বাংলাদেশে বসবাসরত সকল নাগরিকই বাঙালি নামে পরিচিত হবেন। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬(২)-এ বলা হয়েছে, “বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিগণিত হইবেন।” একই সাথে, অনুচ্ছেদ ২৩ক-এ রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণের কথা নিশ্চিত করেছে।
এই সাংবিধানিক কাঠামোর বাইরে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কিছু অংশের পক্ষ থেকে যে ‘আদিবাসী’ (Indigenous People) হওয়ার দাবি উত্থাপিত হয়, তার কোনো আইনি বা সাংবিধানিক ভিত্তি নেই। সরকার আন্তর্জাতিক ফোরামেও এ বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান স্পষ্ট করেছে- বাংলাদেশের ভূখণ্ডে বসবাসকারী সকল ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী বা উপজাতিরা ‘আদিবাসী’ নয়, বরং তারা দেশের উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায় হিসেবে সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত। ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার করলে তা বাংলাদেশের ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা, সার্বভৌমত্ব ও স্থিতিশীলতা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। মূলত, সংবিধানের প্রদত্ত পরিচয়ের প্রতি সম্মান রেখে এবং ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর সাংস্কৃতিক অধিকার সংরক্ষণ নিশ্চিত করেই পার্বত্য অঞ্চলে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা আবশ্যক।
পাহাড়ের রাজনীতি এখন এক সংযোগবিন্দুতে দাঁড়িয়ে- হয় পতন, নয় পুনর্জাগরণ। ক্ষমতার নয়, দেশ, নাগরিক অধিকার, সত্য ও আদর্শের জয় নিশ্চিত করেই এই রাজনীতিকে ইতিহাসের সামনে দায়বদ্ধ এবং জনগণের প্রতি সৎ হতে হবে। কারণ, যে রাজনীতি নিজের ইতিহাসের সত্যকে অস্বীকার করে, তার পতন অবশ্যম্ভাবী। সত্যকে চিরকাল গোপন রাখা যায় না।
আইনের লৌহ-খাঁচা; পদ্ধতিগত বঞ্চনার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ:
পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালি জনগোষ্ঠীর বঞ্চনা কেবল মুখের কথায় নয়, তা আইন ও পদ্ধতির লৌহ-খাঁচায় বন্দি। শান্তিচুক্তি এবং পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন এই অঞ্চলের জন্য যে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা, কোটা সিস্টেম ও উন্নয়ন সহায়তা নিশ্চিত করেছে, তা কার্যত “কেবলমাত্র সেখানকার উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর জন্য নির্ধারিত”।
পাহাড়ের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫০.০৬% হওয়া সত্ত্বেও এই আইনি বেড়াজালে বাঙালি জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে পদ্ধতিগতভাবে বঞ্চিত। দেশের অন্য কোনো অঞ্চলে যেখানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়, সেখানে সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর অধিকার খর্ব করা হয় না। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে, একটি বিশেষ সুবিধা প্রদানের নামে অন্য একটি জনগোষ্ঠীর (বাঙালি) সাংবিধানিক অধিকারকে (অনুচ্ছেদ ২৭: আইনের দৃষ্টিতে সমতা) কার্যত আইনগতভাবে অস্বীকার করা হয়েছে। বাঙালিরা অভিযোগ করে আসছে যে, শান্তিচুক্তি তাদের জন্য শান্তির বদলে এনেছে সুযোগ হারানোর তীব্র যন্ত্রণা।
পরিসংখ্যানের আর্তনাদ; নিয়োগ ও বরাদ্দের বৈষম্য:
বাঙালি বঞ্চনার চিত্র সবচেয়ে স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে সরকারি নিয়োগ ও আর্থিক বরাদ্দের পরিসংখ্যানের নির্মম আঘাতে। এই চিত্র এতটাই বৈষম্যমূলক যে তা উন্নয়নের সুষম বন্টনের অঙ্গীকারকে উপহাস করে।
নিয়োগে নিদারুণ বৈষম্য: পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের প্রায় সকল নিয়োগে উপজাতীয়দের জন্য অগ্রাধিকার বা সর্বোচ্চ কোটা সংরক্ষিত। এই “ট্রাইবাল কোটার সুবিধা বাঙ্গালীদের পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই”। উদাহরণস্বরূপ, গত ২৩ নভেম্বর ২০২৪ তারিখে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের একটি যৌথ প্রকল্পে জনবল নিয়োগে বাঙালি প্রার্থী নিয়োগ দেওয়া হয় মাত্র ১০ শতাংশ, যেখানে অবাঙালিদের হাতে যায় ৯০ শতাংশ। নিয়োগের ক্ষেত্রে এই চরম সংখ্যাগত বৈষম্য স্পষ্ট করে যে, সাংবিধানিক অধিকার (অনুচ্ছেদ ২৯: সরকারি নিয়োগ লাভে সুযোগের সমতা) এখানে কেবল একটি অলিখিত অঙ্গীকার।
উন্নয়ন বরাদ্দে বৈষম্য:
সরকারি বরাদ্দ বণ্টনের পরিসংখ্যান আরও মর্মান্তিক। ২৫ মার্চ ২০২৫-এ পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একটি ৩ কোটি ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকার বরাদ্দের দিকে তাকালে দেখা যায়, মোট জনসংখ্যার ২৭% চাকমা সম্প্রদায় পায় ২ কোটি ৩২ লাখ ৬০ হাজার টাকা, অথচ জনসংখ্যার ৫০.০৬% মুসলিম বাঙালিরা পান মাত্র ৪৭ লাখ ১০ হাজার টাকা। পিসিসিপি’র তথ্য অনুসারে, রাঙামাটির একটি বরাদ্দে বাঙালিরা পেয়েছে মাত্র ৬.৯৫%। খাদ্যশস্য বরাদ্দের ক্ষেত্রেও একই চিত্র: ২,২৭৩ মেট্রিক টন চালের মধ্যে চাকমারা পায় ১,৮৯২ মেট্রিক টন, যেখানে বাঙালি ও অন্যান্যরা মিলে পায় মাত্র ২১৩ মেট্রিক টন। পাহাড়ের আলো ডটকমের রিপোর্টেও দেখা যায়, একটি ক্ষেত্রে মুসলিম বাঙালিরা পেয়েছে মাত্র ৮০ মে. টন চাল, যেখানে চাকমারা পেয়েছে ১,৮১৩ মে. টন।
এই সংখ্যাগত রক্তক্ষরণ প্রমাণ করে, রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে আসা উন্নয়ন অর্থ তার অর্ধেক জনগোষ্ঠীর জন্য হয়ে উঠেছে এক মরুভূমির মরীচিকা।
ক্ষমতা কাঠামোর দুর্লঙ্ঘ্য দেওয়াল:
এই পদ্ধতিগত বঞ্চনার মূল কারণ হলো, বাঙালিরা পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষমতা কাঠামো থেকে সম্পূর্ণ নির্বাসিত। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, আঞ্চলিক পরিষদ, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ, এমনকি ভূমি কমিশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারণী ও প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় সম্পূর্ণভাবে পাহাড়ি নেতৃত্ব দ্বারা পরিচালিত। “ভূমি কমিশন পার্বত্য বাঙালিবিহীন”–এই তথ্যটিই প্রমাণ করে যে, তাদের অধিকার সুরক্ষার মৌলিক প্ল্যাটফর্মগুলোতে বাঙালিদের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই।
বাঙালি জনগোষ্ঠীর অভিযোগ হলো, এই কাঠামোগত কারণে তারা নিজেদের বঞ্চনার প্রতিকার বা আইনি সুরক্ষা চাইলেও, তা প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না। তারা মোট জনসংখ্যার অর্ধেক হওয়া সত্ত্বেও, রাষ্ট্রীয় সুবিধা, চাকরি এবং উন্নয়ন বরাদ্দ থেকে প্রায় সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত। এই বঞ্চনার জন্য বাঙালিরা নিজেরা দায়ী নয়, বরং যে আইনি কাঠামোর মাধ্যমে সুবিধা বন্টিত হচ্ছে, সেই সিস্টেমই বাঙালিদের “বাইরে” রেখে দিয়েছে।
সমতার সন্ধানে রাষ্ট্রীয় বিবেক:
পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালি জনগোষ্ঠীর বঞ্চনার এই দীর্ঘ ইতিহাস কেবল একটি আঞ্চলিক ইস্যু নয়; এটি স্বাধীন বাংলাদেশের সাংবিধানিক সমতার নীতির প্রতি এক চরম নৈতিক চ্যালেঞ্জ। যখন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তার নাগরিকের আত্মপরিচয় হরণ করে এবং পদ্ধতিগতভাবে তাকে অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক সুবিধা থেকে দূরে রাখে, তখন সেই রাষ্ট্র তার কল্যাণমূলক চরিত্র হারায়।
পাহাড়ে শান্তি ও স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে হলে এই পদ্ধতিগত বৈষম্যের দেওয়াল ভেঙে ফেলতে হবে। রাষ্ট্রের প্রতি এখন আবেদন-সংবিধানের মূল চেতনাকে সমুন্নত রেখে, বিশেষ ব্যবস্থার নামে সৃষ্ট বৈষম্যকে দূর করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল নাগরিক, বাঙালি বা ক্ষুদ্র জাতিসত্তা নির্বিশেষে, যেন আইনি সুরক্ষা, অর্থনৈতিক সুযোগ এবং শাসন প্রক্রিয়ায় ন্যায্য হিস্যা লাভ করে, তা নিশ্চিত করার মধ্যেই নিহিত রয়েছে পাহাড়ের সত্যিকারের শান্তি ও সম্প্রীতির বীজ। নচেৎ, সাংবিধানিক সমতার সূর্যোদয় না হওয়া পর্যন্ত এই বঞ্চনার ইতিহাস কেবল দীর্ঘায়িত হতেই থাকবে।
লেখক: সভাপতি, আলীকদম প্রেসক্লাব, বান্দরবান পার্বত্য জেলা।