কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত এখন পর্যটক শূন্য হলে ও ভেসে আসছে একের পর এক সামুদ্রিক বর্জ্য। এসব অপচনশীল পরিবেশের ক্ষতিকরে বর্জ্যের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য। গেল এক সপ্তাহ ধরে জোয়ারের সময় সৈকতের কলাতলী থেকে ডায়াবেটিক পয়েন্ট পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় নানা ধরনের সামুদ্রিক বর্জ্যের ঢল ভেসে আসছে।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, সাগর ও পার্শ্ববর্তী নদী সমূহ দূষণের কারণে বিশেষ করে অপচনশীল প্লাস্টিক বোতল, পলিথিনের ব্যাগসহ নানা আবর্জনা প্রবল জোয়ারের পানির স্রোতে সমুদ্র সৈকতের বালিয়াড়ি এখন বর্জ্যে একাকার হয়ে আছে। এসব বর্জ্যের মধ্যে রয়েছে প্লাস্টিকের বিভিন্ন সামগ্রী, কাঁচের বোতল, ছেড়া জাল, প্লাস্টিকের বোতলসহ মানুষের ব্যবহার্য নানা সামগ্রী।
এর আগে বিভিন্ন সময়ে ভেসে আসা প্লাস্টিক বর্জ্য কক্সবাজার সৈকতের দরিয়ানগর হতে মহেশখালির বিভিন্নস্থানসহ সোনাদিয়া দ্বীপে এসে জমা হয়েছে। সমুদ্রে নিম্নচাপ, বায়ুপ্রবাহ, পানির ঘূর্ণায়ন (এডি), সমুদ্রের পানির গতি প্রবাহসহ সমুদ্র পৃষ্ঠের ধরনের উপর ভিত্তি করে সমুদ্র উপকূলের নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় ভাসমান প্লাস্টিকসহ ও অন্যান্য বর্জ্য জমা হয়েছে বলে দাবি সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহা পরিচালক ও সমুদ্রবিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দারের।
তিনি বলেন, গত কয়েকদিন ধরে আমরা বঙ্গপোসাগরে একটি ছোট আকারের নিম্নচাপ লক্ষ্য করেছি। এসব নিম্নচাপে জোয়ারের সময় সমুদ্রের উপরি পৃষ্ঠের পানি অতি মাত্রায় বেড়ে গিয়ে ফুলে ওঠে এবং ঘূর্ণনের ফলে সমুদ্রের ভাসমান প্লাস্টিক বর্জ্য একসঙ্গে জমা হয়ে ভেসে আসে সৈকতে। এতে মানুষের ব্যবহার্য প্লাস্টিক বর্জ্য, মাছ ধরার জাল, প্লাস্টিক ও কাঁচের বোতল, ফোম, রশিসহ কয়েক’শ টন বর্জ্য সৈকতে এসে জমা হয় এবং কক্সবাজার উপকূলে অবস্থিত বিভিন্ন লতা, গুল্ম, ও ম্যানগ্রোভের সঙ্গে আটকা পড়ে। বর্তমানে এটি কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত টেরেসস্ট্রিয়াল মাইক্রোপ্লাস্টিকের উৎসে পরিণত হয়েছে।
সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার আরও বলেন, সমুদ্রের যে সব জায়গার ভেজিটেশন লাইন ও ওয়াটার লাইনের দূরত্ব বেশি সে জায়গার লম্বা দূরত্ব অতিক্রম করে জোয়ারের পানি আসতে না পারায় প্লাস্টিক বর্জ্যগুলো প্রায়শই দরিয়ানগর থেকে শুরু করে সোনাদিয়া-মহেশখালী সমুদ্রকূলে আটকা পড়ছে। সূর্যের অতি বেগুনি রশ্নি এসব প্লাস্টিককে ভেঙে মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত করে।
অনতিবিলম্বে এই বর্জ্য অপসারণ না হলে সৃষ্ট মাইক্রোপ্লাস্টিকের কারণে সমুদ্রের জীব বৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে। সেই সঙ্গে এটি ভবিষ্যতে মানুষের জন্য স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ হয়ে উঠবে বলে দাবি করেন এই সমুদ্র বিজ্ঞানী।
তিনি বলেন, বর্জ্য ভেসে আসার কারণ আরও বিশদভাবে জানার জন্য বে অব বেঙ্গলের সিজনাল এডি ফরমেশন (পানির ঘূর্ণন), বায়ুপ্রবাহের গতি ও দিক এবং কক্সবাজার কোস্টাল এলাকার বটম ট্রপগ্রাফির ওপর গবেষণা দরকার।
এদিকে সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তরিকুল ইসলামের নেতৃত্বে সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা এসব বর্জ্যের উৎস জানতে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।এর আগে বৃহস্পতিবার বিকেলে কক্সবাজার সৈকতে দুটি ইরাবতী ডলফিন ভেসে আসে ও বুধবার বিকেলে সমুদ্রসৈকতের কয়েক হাজার হাজার মৃত জেলিফিশ ভেসে আসে। শুক্রবার ভোরে থেকে জোয়ারের সময় সৈকতের কলাতলী থেকে ডায়াবেটিক পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় নানা ধরনের বর্জ্যে সমুদ্র সৈকত সয়লাব হতে দেখাযায়।
পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. নজরুল ইসলাম বলেন, কক্সবাজার শহরের সকল অপচনশীল প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্য ছড়া, খাল নদী ভরাট হয়ে সব কিছু যাচ্ছে সাগরে। আর শত সহস্র নৌযান থেকে বর্জ্যগুলো একেবারে বিনাবাঁধায় নিক্ষেপ করা হচ্ছে সাগরে।ফলে সাগরের পানি যেমন দূষিত হচ্ছে। তেমনি অপচনশীল প্লাস্টিক পলিথিন পন্যসামগ্রী জোয়ারের ঠেলায় উপকূলের সাগরতীরের বালিয়াড়িতে এসে জড়ো হচ্ছে। শুধু তাই নয়, এসব প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্য খেয়ে সাগরের অজস্র প্রাণী মারা পড়ছে। বিশেষ করে পলিথিন ও প্লাস্টিক পন্যের অপচনশীল পন্যের ব্যবহার রোধ করা না গেলে দূষণের মাত্রা দিন দিন বাড়তেই থাকবে। এক সময় দেখা যাবে সাগর মৎস্য শূন্য হয়ে পড়বে। এমনকি সাগরের মাছসহ অনেক সামুদ্রিক প্রাণী ইতিমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।