ওয়াসিম আহমেদ |
মশার লার্ভা ধ্বংস করার জন্য নালার পানিতে কালো তেল (লাইট ডিজেল ওয়েল) ব্যবহার করছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) পরিচ্ছন্নতা বিভাগ। মূলত, পানির উপর তেলের আস্তরণে তৈরি হওয়া অক্সিজেন সংকটের কারণে মশার লার্ভা মারা যায়। একই কারণে মশার সাথে মারা যাচ্ছে পরিবেশের উপকারী কীটপ্রতঙ্গ ও মাছ।
গত তিন দশক ধরে ব্যবহৃত এ কালো তেল বৃষ্টির পানির স্রোতে মিশছে কর্ণফুলী নদীতে। কর্ণফুলীর দূষণের পাশাপাশি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীতেও। পানির সাথে মিশে যাওয়া এ কালোতেল দখল নিচ্ছে মাছের শরীর, যা খাবার হয়ে ঘুরেফিরে মানব শরীরেই ঢুকছে। এছাড়া সরাসরি নদীর পানি ব্যবহারকারীরা চর্মরোগের শিকার হচ্ছেন।
বদ্ধ নালার পানিতে মশার লার্ভা মারতে লার্ভিসাইড কীটনাশক এবং উড়ন্ত (পূর্ণাঙ্গ) মশা মারতে ফগার মেশিনের সাহায্যে এডালটিসাইডের ধোঁয়া ছিটানো হয়। সাথে হারবাল কীটনাশক মশকুবান ও ন্যাপথার মিশ্রণও (যা এক ধরনের তেল) ব্যবহার করছে সংস্থাটি। এসবেও মশক নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে চসিক। চসিকের পরিচ্ছন্নতা বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এ মৌসুমে চসিক ১৬ হাজার লিটার কালো তেল কিনেছে। যার দাম প্রায় ৩২ লাখ টাকা। এ তেল মশক নিধনে প্রতিটি ওয়ার্ডের নালা-নর্দমায় ছিটানো হচ্ছে। তিন দশক ধরে সংস্থাটি মশক নিধনে এ পরিবেশ বিধ্বংসী কালো তেল ব্যবহার করে আসছে।
মশার কীটনাশক প্রয়োগকারী মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, একেক সময় একক কীটনাশক ব্যবহার করে সিটি করপোরেশন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মেয়র বদলালে কীটনাশকও বদলায়। তবে এসব মশা মারার কীটনাশকের তুলনায় কালো তেল সবচেয়ে বেশি কার্যকরী। এ কারণে বিগত ৩০ বছর ধরে এ তেল মশা মারতে ব্যবহার করা হচ্ছে।
করোনার মহামারির শেষের দিকে মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেন বর্তমান মেয়র সিটি মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী। করোনার থাবার পর ডেঙ্গু থাবায় নগরবাসী যখন বিপর্যস্ত, তখন মেয়রের আহবানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষক দল, চসিকের ব্যবহৃত কীটনাশক ও নগরীর মশক পরিস্থিতি নিয়ে গবেষণা চালায়। ২০২১ সালের ৩ আগস্ট গবেষণা প্রতিবেদনটি হস্তান্তর করা হয়। ওই প্রতিবেদনে ওঠে এসেছে, কেরোসিন তেলের সাথে না মিশিয়ে পানি মিশিয়ে ব্যবহৃত কীটনাশক মাত্র ১৬ শতাংশ কার্যকর। আর কেরোসিন তেল মিশিয়ে কীটনাশক ব্যবহার করলে ১শ ভাগ কার্যকর।
ওই গবেষণা দলের সদস্য সচিব ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক রাসেল। তিনি পূর্বদেশকে জানান, ‘যেকোন তেল পানিতে ছিটালে একটি আস্তরণ তৈরি করে। যার কারণে পানিতে অক্সিজেন সংকট হয়। এ কারণেই মূলত মশার লার্ভা মারা যায়। এ লার্ভা মারতে গিয়ে মাছের পোনা, জলজ প্রাণী ও পরিবেশের উপকারী অনেক কীটপ্রতঙ্গও মারা যাচ্ছে। আর এর বিরূপ প্রভাব সবাইকে পোহাতে হচ্ছে এবং হবে।’
মশা মারতে কালো তেলের ব্যবহার কর্ণফুলী দূষণের জন্য দায়ী মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘খাল-নালা বা ড্রেনে ব্যবহৃত কালো তেলের গন্তব্য কর্ণফুলী। গত বছর আমরা কর্ণফুলীর দূষণ নিয়ে একটি গবেষণা করেছি। যেখানে ওঠে এসেছিল, ৮৯টি উৎস এবং ৩০ কারণে কর্ণফুলী নদী দূষণের জন্য দায়ী। এসবের মধ্যে অন্যতম ছিলো নদীতে কালো তেলের মিশ্রণ। বছরের পর বছর কালো তেলের ব্যবহার নদীতেও প্রভাব ফেলছে। এ দূষণ কর্ণফুলীতে সীমাবদ্ধ নেই। জোয়ারের সময় হালদা নদীতেও প্রবেশ করে দূষণ সৃষ্টি করছে। অন্যদিকে নতুন ব্রিজ থেকে কালুরঘাট এলাকা পর্যন্ত প্রচুর মানুষ নদীতে গোসল করে, এতে মানুষ সরাসরি এসব তেলের সংস্পর্শে আসছে। যার কারণে চর্মরোগসহ নানারোগের শিকার হচ্ছেন তারা। এমনকি আমরা নদীর যেসব মাছ খাচ্ছি, এসব মাছে তেলের গন্ধ পাওয়া যায়। কেননা পানির সাথে যা-ই থাকে, তা খাবার হিসেবে গ্রহণ করে মাছ। আর সে মাছ আমরা খাবার হিসেবে গ্রহণ করছি। দিনশেষে সে কালো তেল মানব শরীরেই ঢুকছে।’
নগরীর মশক নিধন ও সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে মাঠ পর্যায়ে গবেষণা করা এ গবেষক মনে করছেন, কীটনাশকের কারণে দীর্ঘ মেয়াদী সমস্যা থেকে বাঁচতে হলে দীর্ঘমেয়াধী পরিকল্পনা দরকার। নতুবা এসব লোক দেখানো কর্মসূচি আর মশার কামড় দুটোই সমানতালে চলতে থাকবে।
কর্ণফুলী নদীর অন্যতম শাখা নদী হলো হালদা। এ হালদা দেশের মৎস্য প্রজননের প্রধান প্রাকৃতিক স্থান। কালো তেলের কারণে হালদাতে দূষণ সৃষ্টি হচ্ছে জানিয়ে হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ড. মো. শফিকুল ইসলাম পূর্বদেশকে বলেন, ‘এসব তেল কর্ণফুলী নদী থেকে জোয়ারের সময় হালদা নদীতে প্রবেশ করতে পারে। যা মেজর কার্পজাতীয় মাছের অন্যতম প্রজনন ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এসব তেল নদীর উপরিভাগে একটি স্তর তৈরি করে, যা নদীতে সূর্যের আলো প্রবেশে বাঁধা দেয়। ফলে নদীতে নিমজ্জিত উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া বাধাপ্রাপ্ত হয়। যার প্রভাব পড়ে নদীর সামগ্রিক খাদ্যশৃঙ্খলায়। এসব তেলে রয়েছে বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদান যা নদীর পানিকে দূষিত করে নদীতে বসবাসকারী বিভিন্ন জলজ প্রাণী বিশেষ করে মাছ, উভয়চর ও অমেরুদন্ডী প্রাণীর উপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। অনেক উদ্ভিদ মরে এবং পঁচে গিয়ে নদীতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমান হ্রাস করে। ফলে মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী দম বন্ধ হয়ে মারা যায়। এছাড়া এসব তেল মাছের ফুলকার উপর একটি আবরণ সৃষ্টি করে, ফলে মাছ ফুলকার সাহায্যে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারে না। অর্থাৎ মাছের শ্বসন প্রক্রিয়া মারাত্মকভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়। তাই দেশের অন্যতম মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদাকে বাঁচাতে অবশ্যই কর্ণফ‚লী নদীকে আগে বাঁচাতে হবে।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়া পূর্বদেশকে বলেন, ‘বদ্ধ পানিতে তেল ব্যবহার করে মশার লার্ভা ধ্বংস করা যায়। কিন্তু সিটি করপোরেশনের নালার গন্তব্য খাল হয়ে কর্ণফুলী। সেক্ষেত্রে নদীতে মাছের দুই ধরনের ক্ষতি করে। একেতো মাছ মারা যায়, দ্বিতীয়ত আক্রান্ত মাছ বাজারে চলে আসে। আমাদের বাজারগুলোতে মাছ তো পরীক্ষা-নিরিক্ষা করে বিক্রি হয় না। তাই মাছে কালো তেলের উপস্থিতি পরিষ্কার করাটাও কঠিন। এক্ষেত্রে কালো তেল ব্যবহার না করে বিøচিং পাউডার ব্যবহার করা যায়। সবচেয়ে উত্তম হয়, নালাগুলো পানি পরিষ্কার রাখলে, প্রবাহমান পানি হলে এমনিতেও মশা জন্মায় না। কালো তেলে যে পরিবেশের ‘চরম’ ক্ষতি হচ্ছে সেটা তো নিশ্চিত। এটা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত বলে মনে করি।’
চসিকের ম্যালেরিয়া ও মশক নিধন কর্মকর্তা শরফুল ইসলাম মাহি পূর্বদেশকে বলেন, ‘মশা মারতে কালো তেলের কার্যকারিতা বেশি। পরিবেশে কিছুটা ক্ষতি হয়। কিন্তু মানুষ বাঁচাতে মশা মারতে হবে। তাই কালো তেল ব্যবহার করা হচ্ছে।’
অন্যদিকে বিষয়টি অবগত নন পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম মহানগরের পরিচালক হিল্লোল বিশ্বাস। তিনি পূর্বদেশকে বলেন, ‘পরিবেশের এমন ক্ষতির আয়োজনের কথা আমার জানা নেই। আমরা কথা বলে দেখব, তারপর কি ব্যবস্থা নেওয়া যায়, তা নিয়ে ভাবা হবে।’ সুত্র- দৈনিক পূর্বদেশ