দেশে সামাজিক অবক্ষয় প্রতিরোধে বিশেষ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে সমাজসেবা অধিদফতর। এ ধরণের অবক্ষয় প্রতিরোধমূলক সেবা কার্যক্রম ‘নারী ও কিশোরীদের নিরাপদ হেফাজত কেন্দ্র (সেফহোম)’ নামে প্রত্যেক বিভাগীয় শহরে পরিচালিত হচ্ছে। এ কার্যক্রমের মাধ্যমে অপরাধের শিকার নারী, শিশু ও কিশোরীদের রাষ্ট্রীয়ভাবে সুরক্ষা প্রদান করা হয় এবং পুনর্বাসনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।বিভাগীয় কর্মকর্তা হিসেবে মনিটরিংয়ের লক্ষ্যে অতি সম্প্রতি চট্টগ্রামস্থ হাটহাজারী সেফহোম পরিদর্শন করি। প্রত্যক্ষ করলাম দেশের সামাজিক অবক্ষয়ের ভয়ানক চিত্র। প্রত্যক্ষ্য করলাম বিবিধ কেস : নারী নির্যাতন, নারী ধর্ষণ, শিশু ধর্ষণ, গৃহকর্তা কর্তৃক নির্যাতনের শিকার, পতিতাবৃত্তিতে লিপ্ত কিশোরী, মানবপাচারের শিকার ও অন্যান্য সামাজিক অপরাধের শিকার হেফাজতীদের। বর্তমান সমাজের অবক্ষয়ের রুক্ষরূপ দেখে আমি মর্মাহত। হঠাৎ একটি বিশেষ কেসের প্রতি দৃষ্টি পড়ল। একটি শিশুর কোলে একটি ফুটফুটে বাচ্চা। তত্ত্বাবধায়কের নিকট জানতে চাইলাম। জানা গেল, শিশুটি পিতা কর্তৃক ধর্ষণের শিকার। কোলের শিশুটি পিতার ঔরশ জাত।ধর্ষণের নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতার চিত্র দেখে আমি বাকরুদ্ধ ও বিমর্ষ।
বর্তমান সমাজে নারী ও শিশু নির্যাতন ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সংবাদপত্র, সংবাদ চ্যানেল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিদিন প্রকাশিত হচ্ছে নারী প্রতি সহিংসতা ও নিষ্ঠুরতার প্রতিবেদন। আজ অনেক শিশু, কিশোরী ও নারী বিবিধ নির্যাতন এবংহয়রানির শিকার হচ্ছে। তারা আমাদেরই অতি আপনজন। বিশেষত ধর্ষণ প্রবণতা বৃদ্ধিতে সমাজের মানুষ উদ্বিগ্ন। এধরণের নগ্নতা যেমন সামাজিক অপরাধ, তেমনি আইন বিরোধী কাজও বটে। ধর্ষণ সংস্কৃতি সমাজ ও সভ্যতার উপর চরম আঘাত। সুশীল সমাজের জিজ্ঞাসা: নারী ও শিশুরা কেন যৌন আক্রমণের শিকার ? এরূপ সামাজিক অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধের উপায় কি?নিশ্চই, প্রয়োজন সঙ্গবদ্ধ প্রচেষ্টা। প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন।
ধর্ষণ একটি ঘৃণ্য অপরাধ। এটি ধর্মীয় রীতি, নীতি, সমাজ, সংস্কৃতি, সভ্যতা ও সামাজিক প্রথা বিরোধী কাজ।দেশের প্রচলিত দু’টি আইনে ধর্ষণের সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে। ১৮৬০ সালের দন্ডবিধি’র ৩৭৫ ধারায় নারীর সাথে ৫ ধরণের যৌন সহবাস করাকে ধর্ষণ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। যথা: ১. তাহার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ২. তাহার সম্মতি ব্যতীত ৩. তাহার সম্মতিক্রমে (মৃত্যু বা আঘাতে ভয় দেখিয়ে) ৪. প্রতারণামূলকভাবে সম্মতি আদায় ৫. তাহার সম্মতি সহকারে বা ব্যতিরেকে, যেক্ষেত্রে সে চৌদ্দ বছরের কম বয়স্ক। অপর দিকে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০২০’ এর ৯ নং ধারায় ধর্ষণের ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে। এ ধারায় উল্লেখ: ১.বিবাহ বন্ধন ব্যতীত ১৬ বছরের উপরে কোন নারীর সাথে সম্মতি ছাড়া বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌন সঙ্গম ২. বিবাহ বন্ধন ব্যতীত ১৬ বছরের উপরের কোন নারীকে ভয় দেখিয়ে যৌন সঙ্গম এবং প্রতারণামূলক যৌন সঙ্গম ৩. ১৬ বছরের নিচের নারীর সাথে সম্মতিতে বা সম্মতি ছাড়া যৌন সঙ্গম।যৌন তৃপ্তি লাভ মানুষের অন্যতম জৈবিক চাহিদা। এধরণের তৃপ্তি লাভের সমাজ স্বীকৃত উপায় আছে। কিন্তু মানুষ যৌন কামনা চরিতার্থ করার জন্য প্রচলিত রীতি-নীতির তোয়াক্কা করছে না। বিবিধ যৌন অপরাধ করছে। যেমন: ধর্ষণ, সমকামিতা, ব্যাভিচারী, পতিতাবৃত্তি, ইভ-টিজিং ইত্যাদি।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সম্প্রতি ২০২১ সালের প্রথম ৬ মাসের (জানুয়ারী-জুন) নারী ও শিশু ধর্ষণের তথ্যচিত্র প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনের ভিত্তি হচ্ছে ১৩টি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের তথ্য। প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৪৩১ জন কন্যা শিশুসহ ৬৯৭ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে।তন্মধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার ৪১ জন কন্যা শিশুসহ ১০৪ জন নারী। ধর্ষণের পর হত্যার শিকার ১২ জন কন্যা শিশুসহ ১৬ জন নারী। যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে ৩৪ জন কন্যা শিশুসহ ৪৬ জন নারী। হত্যার শিকার হয়েছে ৬২ জন কন্যা শিশুসহ ২২১ জন নারী।গত ২০২০ সালে দেশের নারী বিষয়ক মানবাধিকার সংস্থা ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্র(আসাক)’ হতে একই ধরণের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে দেখা যায়, সমগ্র দেশে ১০ মাসে (জানুয়ারী-অক্টোবর) ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৩৪৯টি। ধর্ষণের পর ৪৬ জন হত্যাকান্ডের শিকার ও ১৩ জন আতœহত্যা করে।প্রতিবেদনে আরো দেখা যায়, প্রতি মাসে গড়ে ১৩৫ টি ধর্ষণ বিষয়ক সংবাদ প্রকাশ পায়। দৈনিক ৪-৫ টি ধর্ষণের ঘটনা ছাপা হয়। এ ধরণের প্রকাশিত প্রতিবেদন সমগ্রদেশের ধর্ষণের প্রকৃত চিত্র প্রকাশ করে না। কারণ পত্রিকায় শুধুমাত্র উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা স্থান পায়।
ধর্ষণের কিছু মনস্তাত্ত্বিক কারণ আছে। মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণের জনক, চিকিৎসক ও ¯œায়ু বিশেষজ্ঞ সিগমান্ড ফ্রয়েড মানুষের যৌন প্রবৃত্তি সম্পর্কে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। তিনি তাঁর মনস্তাত্ত্বিক মতবাদ ও মনঃসমীক্ষণ মতবাদে উল্লেখ করেন, যৌন চিন্তাই মানুষের সকল কর্মের মূলভিত্তি। পুরুষের সব তাড়না যৌন তাড়না দ্বারা পরিচালিত। শৈশবকাল থেকে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত মানুষের মধ্যে কামপ্রবৃত্তি বর্তমান থাকে। ফ্রয়েড যাকে লিবিডো(খরনরফড়) বলে উল্লেখ করেছেন। তিঁনি আরও দু’ধরণের বিশেষ লিবিডোর কথা বলেছেন, ১. মর্ষকাম(গধংড়পযরংস) ২. ধর্ষকাম (ঝধফরংস)। মর্ষকাম হচ্ছে, প্রেম-প্রীতি-ভালবাসার মাধ্যমে যৌন সুখ লাভ করা। অপরদিকে ধর্ষকাম হচ্ছে, নিপীড়নের মাধ্যমে যৌন সুখ লাভ করা। সাধারণত ধর্ষকামিরা নিপীড়নের মাধ্যমে সুখ লাভ করে।আবার মনুষের মধ্যে দু’ধরণের পারস্পরিকবিপরীত বৃত্তি কাজ করে। যথা: জীবনবৃত্তি (খরভবষঁংঃরহবঃ) ও মরণবৃত্তি(উবধঃযষঁংঃরহবঃ)। জীবনবৃত্তি মানষকে সৃষ্টির প্রেরণা যোগায়। মানুষ লক্ষ্যে পৌঁছায় : সৃষ্টিসাধন, ক্ষুধা নিবারণ, তৃষ্ণা মেটানো ও যৌনতৃপ্তির মাধ্যমে। মরণ প্রবৃত্তি হচ্ছে, ব্যক্তির সুখ লাভে ব্যর্থতা। মরণ প্রবৃত্তি দ্বারা তাড়িত হয়ে ব্যক্তি ধ্বংসাতœক কাজ, হিংসাতœক কাজ বা আতœহত্যার চেষ্টা চালায়। বিখ্যাত জনতত্ত্ববিদ রবার্ট ম্যালথাস ১৯০৫ জনসংখ্য তত্ত্বে উল্লেখ করেন, মানুষ ক্ষুধা প্রবৃত্তি ও যৌন প্রবৃত্তি নিবারণ করা ছাড়া মানুষ চলতে পারে না। মানুষের অন্যতম জৈবিক চাহিদা হচ্ছে, ক্ষুধা নিবারণ ও যৌন তৃপ্তি লাভ। মানুষ ব্যক্তিক সুখের জন্য যেকোন মূল্যে যৌন তৃপ্তি লাভ করতে চায়। কিন্তু এক্ষেত্রে বাধা সমাজ ও সভ্যতা। সভ্যতার বিধিবিধান দ্বারা মানুষকে যৌন চাহিদা পূরণে হতে বিরত রাখা হচ্ছে।
করোনা মহামারি চলছে সমগ্র বিশে^।মহামারি পরিস্থিতিতে দেশে কর্মসংস্থান কমছে, মানুষ কর্মহীন হচ্ছে, কর্মচ্যুত হচ্ছে, দারিদ্র্যতা বাড়ছে, শিক্ষা থেকে ছাত্রী ঝড়ে পড়ছে, বাল্যবিবাহ বৃদ্ধি পাচ্ছে, শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ কমে যাচ্ছে। দেশের প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় যেকোন সংকটময় পরিস্থিতি মোকাবেলায় পুরুষ প্রথম সারির যোদ্ধা হিসেবে কাজ করে। নারীরা গৃহস্থালী, পরিবার, সন্তান ও প্রবীণদের দায়িত্ব নেয়। ফলে মহামারি প্রেক্ষাপটে নারীর কর্তৃত্ব খর্ব হচ্ছে। অপরদিকে পুরুষের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে পুরুষের মধ্যে আত্ম অহমিকা ও অপরাধবোধ জাগ্রত হয়। পুরুষ শ্রেণি তুচ্ছ অজুহাতে পারিবারিক সহিংসতাসহ নানান অপরাধ করছে। যার মধ্যে অন্যতম যৌন আক্রমণ ।
দেশের নারী সমাজ আজ উদ্বিগ্ন। আমাদের শিশু-কিশোরীর নিরাপত্তাহীনতায়। দেশের মেয়েরা বাড়িতে, রাস্তায়, স্কুলে, খেলার মাঠে, গণপরিবহনে ও কর্মক্ষেত্রে কোথাও নিরাপদ নয়। অপরদিকে করোনা কালে মানুষ গৃহবন্ধী। এ সময়েও ধর্ষণ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধর্ষণকারী প্রত্যেকেই ভূক্তভোগীদের পরিচিত-প্রতিবেশী, আতœীয়, প্রেমিক, প্রাইভেট টিউটর, স্কুল ও মাদ্রাসার শিক্ষক। আতঙ্কের বিষয় ধর্ষণের শিকার ৬৪ শতাংশ ভূক্তভোগী শিশু-কিশোরী। পিতা নিজ কন্যাকে ধর্ষণ করছে। শিক্ষক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের শিকারে পরিণত করছে। এ যেন সমাজের চরম লজ্জা ও নৈতিকতার অপমৃত্যু। অভিজাত মহলে পরিমণিদের চাহিদার ব্যপকতা দেখে, সভ্য সমাজ আজ চরম লজ্জিত। পরিমণিরা আজ স্বেচ্ছায়, ইচ্ছায় ও অনিচ্ছায় ধর্ষণের শিকার। ক্ষতাবানরা অনৈতিক যৌন লালসা চরিতার্থ করতে ব্যবহার করছে নিজ ক্ষমতা ও অঢেল অর্থ। পুরষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা নারী সমাজের উপর যৌন অপরাধের দায় চাপাতে সদা তৎপর। রাষ্ট্রের পক্ষে ধর্ষক, ধর্ষণের শিকার ও ধর্ষণের সমর্থকদের চিহ্নিত করা কঠিন। ধর্ষক অনেক ক্ষেত্রে পশ্রয় পায় নিয়ন্ত্রক ও প্রতিরোধকারীর পক্ষ হতে।
ধর্ষণ একটি নিষ্ঠুর সামাজিক অপরাধ। এ অপরাধ নিয়ন্ত্রণে বিদ্যমান আইন সংশোধন করেছে। নারী ও শিশু নির্যাতন আইন ২০০০ এর ৮ ধারা সংশোধন করেছে। তথাপি অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না । বরং বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু কেন ? মানুষকে যৌন-জৈবিক চাহিদা মেটাবে বৈধ পন্থায়। ধর্মীয় অনুশাসন, সমাজ, সংস্কৃতি ও সভ্যতার রীতি মতে। বিকৃত যৌনাচার সমাজ, সভ্যতা ও রাষ্ট্রের জন্য হুমকী। যৌনচারীরা সমাজ ও পরিবারের কাছে চরম লজ্জার বস্তু। এ অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সমাজ, সামাজিক প্রতিষ্ঠান, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, স্থানীয় সরকার, জনপ্রশাসন ও সুধী মহল প্রত্যেককে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে। অবৈধ যৌনাচার নির্মূল হউক। ধর্ষণমুক্ত শোভন সমাজ প্রতিষ্ঠা হোক, সকলের অঙ্গীকার।
লেখক………
মোহাম্মদ শাহী নেওয়াজ
বি,কম, (অনার্স) এম, কম, (ব্যবস্থপনা) জাবি
এম এস এস (সমাজকল্যাণ) ঢা:বি
এম এস এস (মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায় বিচার) জগ:বি:
সহকারী পরিচালক
সমাজসেবা অধিদফতর
বিভাগীয় কার্যালয়, চট্টগ্রাম।
মোবাইলঃ ০১৮১৮৬৭৪৮৬২