মো. নুরুল করিম আরমান |
এক সময় পার্বত্য বান্দরবান জেলার লামা, আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার রাস্তার পাশে দেখা যেত সিনেমার রঙিন রঙ্গিন পোস্টার। দিনভর চলতো মাইকে প্রচারণা। সারাদিন হাঁড়ভাঙা খাঁটুনির পর সন্ধ্যায় সিনেমা হলে ভিড় জমাতো মানুষ। প্রতিটি হলে সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা ও রাতে চারটি প্রদর্শনী চললেও প্রতিটি প্রদর্শনী নারী ও পুরুষ দর্শকে পরিপূর্ণ থাকতো। সেই সিনেমা এখন সুদূর অতীত। কতদিন সিনেমা হলে যাওয়া হয়নি, এখন অনেকে মনে করে বলতে পারছেন না। কালক্রমে দর্শক শূণ্যতায় হলগুলো একের পর এক বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ হয়ে যাওয়া সিনেমা হলগুলোতে গড়ে তোলা হয়েছে মার্কেট, দোকান, রাইস মিল ও বসতবাড়ি। ফলে ডিজিটাল যুগে এসেও এই তিন উপজেলায় চিত্তবিনোদনের আর কোন ব্যবস্থা রইল না। এ পেশায় নিয়োজিতরা বেচে নিলেন অন্য পেশা।
তথ্য অফিস সূত্র জানায়, আশির দশকের বিভিন্ন সময় লামা উপজেলায় ৪টি, আলীকদমে ১টি ও নাইক্ষ্যংছড়িতে ১টি সিনেমা হল স্থাপিত হয়। নব্বই দশকেও এসব সিনেমা হলগুলো সগৌরবে চলছিল। কিন্তু ২০০০ সালের দিকে সিনেমা হলগুলোর সামনে দিন দিন দর্শকের দেখা কমতে থাকে। এতে লোকসানের মুখে পড়ে মালিক পক্ষ ২০০৫ সালে বন্ধ করে দেন আলীকদমের পর্বত সিনোম হল, ২০০৯ সালে লামা উপজেলার বনফুল সিনেমা হল, ২০০১ সালে কুমারীর বনগিরি ও নাইক্ষ্যংছড়ির পাহাড়িকা সিনেমা হল ও ২০১০ সালে বন্ধ হলো আজিজনগরের ছবিঘর সিনেমা হল। এরপর কোন মতে চলছিল আজিজনগরের সুর বিতান, সেটিও দর্শক শূণ্যতায় ২০১৯ সালে বন্ধ হয়ে যায়।
সুর বিতান সিনেমা হলের ভাড়াটিয়া সাব্বির আহমদ বলেন, হলটি যখন শুরু হয় তখন বিনোদনের তেমন ব্যবস্থা ছিল না। এতো চ্যানেলও ছিল না। বিধায় সিনেমা ব্যবসা জমজমাট ছিল তখন। এখন ঘরে বসে প্রাইভেট চ্যানেলে হিন্দি বাংলা ছবি দেখা যাচ্ছে, অথচ হলে দেখা যাচ্ছে না। কেন মানুষ হলে গিয়ে সিনেমা দেখবে। তিনি আরও বলেন, নব্বই দশকের দিকে টিভিতে সপ্তাহে একটি সিনেমা প্রচার করা হতো। কিন্তু নব্বই দশকের শেষ দিকে টিভি চ্যানেল চালু হওয়ার পর প্রতিদিনই কোন না কোন সিনেমা প্রচার শুরু করে। এছাড়া মোবাইল ও সিডিতে প্রতিনিয়ত দেখা যায় সিনেমা। এসব কারণে সিনেমায় ধ্বস নামে। অনেকদিন ধরে এখানে সুর বিতান চালিয়েছি। করোনাকালীণ সময় দর্শক শূণ্যতায় লোকসান গুনতে গুনতে পিঠ দেয়ালে ঠেকে যায়। তাই এ ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে এখন অন্য পেশায় আছি। একই কথা জানালেন, ছবিঘর সিনেমা হলের মালিক নাজেমুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি জানান, হলটিতে এখন রাইস মিল করা হয়েছে। তবে ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণ, অবাধে মোবাইল সিডিতে চলচ্চিত্র প্রদর্শন বন্ধে ব্যবস্থা নিলে হয়ত হলে দর্শক ফিরবে বলেও মন্তব্য করেন স্থানীয় নাজিম উদ্দিন রানা, মো. সেলিম উদ্দিনসহ অনেকে।
অভিজ্ঞদের মতে, মানুষ এখন চায়ের দোকানে বসে টিভি ও সিডির মাধমে মিনি সিনেমা হল তৈরী করে, সেখানে তাদের চিত্তরঞ্জনের খোরাক মেটাচ্ছেন। মোবাইল আর আকাশ সংস্কৃতির গ্রাসে মানুষ ভুলতে বসেছে রূপালী পর্দার সেই সোনালী দিনগুলির কথা। আবার বেশ কয়েক বছর যাবৎ সুস্থ চলচ্চিত্র নির্মিত না হওয়ায় মানুষ ব্যক্তিগত ও পারিবারিকভাবে সিনেমা হলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়।
লামা বনফুল সিনেমা হলের মালিক মো. ইউছুপ আলী বলেন, একসময় লামা, আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় ৬টি সিনেমা হল চালু ছিল। এসব সিনোম হলগুলো আমাদের নিয়ন্ত্রণেই রমরমা ব্যবসা হতো। অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও ছিল। কিন্তু স্যাটেলাইট চ্যানেল গুলোর সুবাদে ঘরে বসে সব ধরনের সিনেমা দেখার সুযোগ পাওয়ায় দর্শক সিনেমা হলে যাওয়া কমে যায়। এতে মাস শেষে বিদ্যুৎ বিল ও কর্মচারিদের বেতন পর্যন্ত তোলা যাচ্ছিল না। ফলে একে একে হলগুলো বন্ধ করে দিতে বাধ্য হই। বনফুল সিনেমা হলটি ভেঙ্গে এখন আলী মিয়া শপিং কমপ্লেক্স গড়ে তোলা হয়েছে।
এদিকে আলীকদম পর্বত সিনেমা হলের মালিক মো. আইয়ুব আলী জানায়, এক সময় পর্বত সিনেমা হল ছিল আলীকদমের বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম। সেই সময় দর্শকের পদচারনায়ও মুখরিতও ছিল হলটি। ধীরে ধীরে মানহীন সিনেমা, অনুন্নত পরিবেশ, হল আধুনিকায়ন না হওয়া, হাতের মুঠোয় ইউটিউব এ সিনেমা দেখার অপার সুযোগ থাকায় সিনেমা হল থেকে দর্শকরা মুখ ফিরিয়ে নেয়। এতে হলটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হই। সিনেমা হলটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেখানে আর চিত্ত বিনোদনের ব্যবস্থা রইল না। একই কথা বলেন, নাইক্ষ্যংছড়ির পাহাড়িকা সিনেমা হলের মালিক তৈয়ব আলী।
লামা সহকারী তথ্য অফিসার রাশেদুল হক রাসেদ জানান, সিনেমা হল চালু আছে কিনা জানতে গত মাসে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। এ প্রেক্ষিতে লামা, আলীকম ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় এক সময় ৬টি সিনেমা হল থাকলেও বর্তমানে কোন সিনেমা হল চালু নেই বলে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এতদ্বঞ্চলে চিত্তবিনোদনের কোন ব্যবস্থা রইল না।