চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) প্রতিষ্ঠার ৩৩ বছরেও ই-বর্জ্য সংগ্রহে আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত কোনো ব্যবস্থাপনাগার গড়ে তোলতে পারেননি। এ শহরের যত্রতত্রই পড়ে রয়েছে ই-বর্জ্যের স্তূপ। সাধারণ বর্জ্যের সঙ্গে মেডিকেল, শিল্পকারখানা ও ই-বর্জ্যের মতো সংক্রামক এবং বিপজ্জনক ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও চলছে সনাতন পদ্ধতিতে। বাস্তবে ই-বর্জ্য ভারী ধাতু বহন করে, যা মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এছাড়া অনিয়ন্ত্রিত ও অবৈজ্ঞানিকভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা হতে পারে আরো ভয়ংকর।
চট্টগ্রামের সিডিএ মার্কেট, কক্সি মার্কেট, আইস ফ্যাক্টরি রোড, ভাটিয়ারী ও কদমতলীতে এমনকি দেশের বিভিন্ন স্থানের আবাসিক এলাকাতে সনাতন পদ্ধতিতে রিসাইক্লিং করা হয়। অনানুষ্ঠানিক খাতে গড়ে ওঠা এসব রিসাইক্লিং কেন্দ্রে আইনকানুন ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের তেমন কোন বালাই নেই। ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে এসব কেন্দ্রে কাজ করে প্রায় ৫০ হাজার শিশু-কিশোর। এই কাজে জড়িত প্রায় ৮৩ শতাংশ শিশু-কিশোর কিডনি ও ফুসফুস ড্যামেজ, উচ্চ রক্তচাপ, মানসিক বিষণ্নতা, নার্ভ সিস্টেমের দুর্বলতা, শ্রবণশক্তি হ্রাস, পঙ্গুত্বসহ নানাবিধ জটিল রোগে আক্রান্ত। এতৎসত্ত্বেও ই-বর্জ্যের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা নেই বললেই চলে।
যদিও চট্টগ্রামে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য জাপানের একটি ও দক্ষিণ কোরিয়ার একটি, মোট দুটি প্রতিষ্ঠান প্রস্তাব জমা দিলেও প্রকল্পটি কাকে দেবেন এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি সিটি কর্পোরেশন। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনার পর বিষয়টি নির্ধারণ করা হবে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম।
চসিক সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম নগরীতে প্রতিদিন প্রায় ২,১০০ টন বর্জ্য উৎপাদিত হয়। এসব বর্জ্য মানুষের ঘরবাড়ি থেকে সিটি কর্পোরেশনের মাধ্যমে পৌঁছায় দুটি ল্যান্ডফিলে (ভাগাড়)। কিন্তু এসব বর্জ্যের যথাযথ ব্যবস্থাপনায় নিঃশেষ না করায় আবর্জনার ভাগাড় দুটির (ল্যান্ডফিল) উচ্চতা বাড়ছে। তাই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে চসিক।
তথ্যমতে, ২০১৯ সালে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় চট্টগ্রামে গবেষণাগার স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর)। ই-বর্জ্য থেকে মূল্যবান ধাতু উদ্ধার করে তা পুনর্ব্যবহারের লক্ষ্যে চট্টগ্রামে একটি লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং সেবাকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নিলেও তা অদৃশ্য কারণে আটকে রয়েছে। মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাবনাও জমা রয়েছে বলে জানা যায়। সূত্রমতে, এ প্রস্তাবিত প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে এই খাতে ৪০ হাজার ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা গড়ে উঠবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সঠিকভাবে ই-বর্জ্য প্রক্রিয়াজাত করলে তা মেটাল ও অ্যালয়ের ভালো উৎস হতে পারে। যেমন কম্পিউটার হার্ডডিস্কের অন্যতম উপাদান অ্যালুমিনিয়াম ও স্টেইনলেস স্টিল। তাই হার্ডডিস্ক হতে পারে এ দুটি উপাদানের ভালো উৎস। ড্রাইসেল ব্যাটারিতে পরিত্যক্ত অবস্থায় ১৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ জিংক পাওয়া যায়, যা জিংকের ভালো একটি উৎস হতে পারে। মোবাইল ফোনের ব্যাটারি ও ল্যাপটপে লিথিয়াম আয়ন প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার হয়। এগুলো থেকে লিথিয়াম সল্ট প্রস্তুত করা সম্ভব।
এদিকে বাংলাদেশ ইলেকট্রিক্যাল মার্চেন্ডাইজ ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিইএমএমএ) সূত্রমতে, প্রতি বছর দেশে ৩২ কোটি টন ইলেকট্রনিক পণ্য ব্যবহার হয়। তবে এসব পণ্যের মাত্র ২০-৩০ শতাংশ রিসাইকেল বা পুনর্ব্যবহার উপযোগী করা হয়। আর বাকিটা অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে ভেঙে ফেলা হয় অথবা ফেলে দেয়া হয়। দেশে কম্পিউটার, সেলফোন, টেলিভিশন, রেফ্রিজারেটর, ফটোকপি, ওয়াশিং মেশিন, এয়ারকন্ডিশন, ডিভিডি প্লেয়ার, সিএসএফ বাল্ব প্রভৃতি ইলেকট্রনিক পণ্য অধিক পরিমাণে ব্যবহার হয়। এসব ইলেকট্রনিক পণ্যে এক হাজারেরও বেশি ধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য থাকে। এসবের মধ্যে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক লেড, মারকারি, জিংক, ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম, বেরিলিয়ামসহ বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে ই-বর্জ্যে এক হাজারেরও বেশি বিভিন্ন ধরনের বিষাক্ত পদার্থ থাকে এবং নিত্যব্যবহার্য ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলো বেশি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। টেলিভিশন ও কম্পিউটার মনিটরে থাকা সিসা, পারদ, কপার এবং মাদারবোর্ডে থাকা বেরিলিয়াম, সেলফোন, রেফ্রিজারেটর ও এসি’তে ব্যবহৃত ক্ষতিকর পদার্থসমূহ ক্যান্সার ও কিডনি নষ্ট হওয়া, থাইরয়েড হরমোন বিপর্যস্ত করা সহ বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) এর ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. হাসান খালেদ রউফ বিবার্তাকে বলেন, ই-বর্জ্য নতুন কোনো ধারণা নয়। উন্নত দেশে এ ধরনের বর্জ্য আলাদাভাবে সংগ্রহ করা হয় এবং বর্জ্য অনুযায়ী পুনর্ব্যবহার কিংবা ধ্বংস করা হয়। তবে আমাদের দেশে এখনো আলাদাভাবে ই-বর্জ্যের নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই বললে চলে। তবে চাইলে সহজেই চসিকসহ দেশের অন্যান্য শহর পরিচ্ছন্নতার দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলো এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে পারে।’
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াস চৌধুরী বিবার্তাকে বলেন, সব হাসপাতালে যেহেতু ইনসিনারেটর বসানো সম্ভব না, সেহেতু আলাদাভাবে সংগ্রহ করে শহরের একটি ইনসিনারেটরে ধ্বংস করবে। নগরীর হালিশহর আবর্জনাগারে সব জমা করা হয় বলে তিনি জানান।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, গৃহস্থালি পণ্যে থাকা ই-বর্জ্যের ক্ষতির মাত্রা অনেক বেশি। অপচনশীল এসব বর্জ্যের ধাতু এবং রাসায়নিক মাটির গুণাগুণ নষ্ট করে। এসবের প্রভাবে মানবদেহে ক্যান্সার, শ্বাসকষ্ট, কিডনি ও লিভারের বিভিন্ন সমস্যা এবং মস্তিষ্ক ও রক্ত নালীর বিভিন্ন রোগ হতে পারে।
বাংলাদেশ ইলেকট্রিক্যাল মার্চেন্ডাইজ ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের মতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৩.২ মিলিয়ন টন ইলেকট্রনিক সামগ্রী ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে ২০-৩০ শতাংশ রিসাইকেল হয় এবং বাকিটুকু যত্রতত্র ফেলে দেওয়া হয়। অর্থাৎ ই-বর্জ্যে পরিণত হয়।