বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অঞ্চলের ভূতাত্ত্বিক নীরবতা হাজার বছরের। এর নিচে চাপা পড়ে আছে রিখটার স্কেলে ৮.৫ থেকে ৯.২ মাত্রার মতো একটি প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পের বিপুল শক্তি। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল এখন সেই মহা-ভূমিকম্পের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে, যা যেকোনো মুহূর্তে আঘাত হানতে পারে।
দুই প্লেটের ঘর্ষণ: মহা-বিপদকেন্দ্রে চট্টগ্রাম
ভূ-তত্ত্ববিদদের মতে, বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের অবস্থান প্রধানত দুটি সক্রিয় টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে রয়েছে ইন্ডিয়ান প্লেট এবং বার্মা প্লেট (বা ইউরেশিয়ান প্লেটের সাব-প্লেট)। ইন্ডিয়ান প্লেটটি প্রতি বছর পূর্ব দিকে বার্মা প্লেটের নিচে ক্রমাগত তলিয়ে যাচ্ছে এবং বার্মা প্লেটটি পশ্চিম দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এই দুই প্লেটের সংযোগস্থলেই সৃষ্টি হয়েছে বিশাল বার্মিজ ফল্টলাইন বা চ্যুতি।
বিশেষজ্ঞদের দীর্ঘ গবেষণায় উঠে এসেছে যে এই দুটি প্লেটের ঘর্ষণে এই অঞ্চলে বিপুল পরিমাণ স্থিতিস্থাপক শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে, যা প্রায় ৪০০ বছর ধরে জমা হচ্ছে বলে অনুমান করা হয়। মূলত এই ভূতাত্ত্বিক অবস্থানের কারণেই চট্টগ্রাম, সিলেট ও ঢাকা অঞ্চলকে বাংলাদেশে ভূমিকম্পের সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
উপকূলের নিচে দুই প্লেটের মরণফাঁদ
ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক হুমায়ুন আখতারের দীর্ঘ গবেষণার ফল বলছে, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, বিশেষ করে চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রাম-কক্সবাজার অঞ্চল দুটি শক্তিশালী টেকটোনিক প্লেটের মিলনস্থল, যা ভূতাত্ত্বিক ভাষায় সাবডাকশন জোন নামে পরিচিত। পশ্চিম থেকে আসা ভারতীয় প্লেটটি ক্রমাগত পূর্বের বার্মা প্লেটের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। এই প্লেট দুটির মধ্যে সংঘর্ষের ফলে এই সাবডাকশন জোনের পশ্চিম প্রান্তে, অর্থাৎ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে, বহু বছর ধরে বিপুল পরিমাণ স্থিতিস্থাপক শক্তি জমা হয়ে আছে।
বিশেষজ্ঞদের সতর্কবাণী অনুযায়ী, এই অঞ্চলে গত প্রায় এক হাজার বছরের মধ্যে বড় মাত্রার কোনো ভূমিকম্পের শক্তি পুরোপুরি মুক্ত হয়নি। এই দীর্ঘ নীরবতা সংকেত দিচ্ছে, সঞ্চিত শক্তির পরিমাণ এখন ধারণক্ষমতার চূড়ান্ত পর্যায়ে।
অধ্যাপক হুমায়ুন আখতারের বিশ্লেষণ আরও উদ্বেগজনক: ‘আমরা শুধু জানি এই সঞ্চিত শক্তি এক সময়ে বের হবেই। এর কোনো বিকল্প নেই। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ভূমিকম্প অবধারিত।’
সঞ্চিত শক্তি যখন ধারণক্ষমতা ছাড়িয়ে যাবে, তখন সেখানে যে ভয়াবহ ভূমিকম্প হবে, তার মাত্রা রিখটার স্কেলে ৮.৫ থেকে ৯.২ পর্যন্ত হতে পারে।
অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার গবেষণার বিস্তারিত জানিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্পের প্রধান দুটি উৎসের মধ্যে একটি হচ্ছে সিলেট থেকে ত্রিপুরা হয়ে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, টেকনাফ পর্যন্ত। এই উৎসটি খুব ভয়ংকর। তিনি আরও বলেন, সাবডাকশন অঞ্চলের পশ্চিম প্রান্তে বাংলাদেশের ভেতরে প্রচণ্ড সংঘর্ষের কারণে প্রচুর শক্তি জমা হয়ে আছে। এই সঞ্চিত শক্তি একবারেও যেমন বের হতে পারে, আবার ধীরে ধীরেও বের হতে পারে।
কাছের ফল্টলাইন সক্রিয়
চট্টগ্রাম এবং এর নিকটবর্তী দূরত্বে বেশ কয়েকটি সক্রিয় ফল্ট বা চ্যুতি রেখা রয়েছে, যা এই অঞ্চলকে বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। এর মধ্যে প্রধান হলো সীতাকুণ্ড-টেকনাফ ফল্ট এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বরকল ফল্টলাইন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো, চট্টগ্রাম, ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্তের কাছাকাছি বিস্তৃত বার্মিজ ফল্ট লাইন। যেহেতু ভারতের মিজোরাম এবং মিয়ানমার চট্টগ্রামের খুবই কাছাকাছি, বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলে, তাই এই অঞ্চলের ফল্টলাইনে সৃষ্ট যেকোনো বড় ভূমিকম্পের সরাসরি আঘাত বাংলাদেশে এসে পড়ার আশঙ্কা অনেক বেশি।
চট্টগ্রামের কাছাকাছি বড় ভূমিকম্প
১৯৯৭ সালের ২১ নভেম্বর বিকেল ৪:২৩ মিনিটে (স্থানীয় সময়) সংঘটিত ৬.১ মাত্রার ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল ভারত-বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন মিজোরাম রাজ্যে। চট্টগ্রাম নগরীর নিকটবর্তী দূরত্বে হওয়া এই ভূমিকম্পে একটি পাঁচতলা ভবন ধসে ২৩ জন নিহত হয়েছিলেন।
পাহাড়ের কথা ডেস্ক।
২০২১ সালের ২৬ নভেম্বর ভোর ৫:৪৫ মিনিটে ভারত-মিয়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন মিজোরামের কাছে ৬.২ মাত্রার একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প হয়েছিল, যা চট্টগ্রাম থেকে তুলনামূলকভাবে নিকটবর্তী দূরত্বে অবস্থিত ছিল। ২০২২ সালের ২১ জানুয়ারি বিকেলে মিয়ানমারের ফালাম শহরে ৫.৪ মাত্রার কম্পন অনুভূত হয়েছিল, যা চট্টগ্রাম থেকে মাত্র ২২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ছিল। ২০২৩ সালের ২ ডিসেম্বর সকালে রামগঞ্জ, চট্টগ্রাম/ফেনীর কাছাকাছি ৫.৫ মাত্রার ভূমিকম্প। সূ্ত্র-পাহাড় সমুদ্র











প্রধান সম্পাদক : বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রিয়দর্শী বড়ুয়া,
সম্পাদক : মো. নুরুল করিম আরমান,
আইন বিষয়ক উপদেষ্ঠা : এ্যডভোকেট ফয়সাল আজিজ