মো. নুরুল করিম আরমান ।
লাইনঝিরি মোহাম্মদীয়া ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রসা। বান্দরবান জেলার লামা পৌরসভা এলাকার লাইনঝিরিতে এ প্রতিষ্ঠানটির অবস্থান। পাহাড়ী অধ্যুাষিত অনগ্রসর জনপদে ইসলামি শিক্ষা তথা কোরআন হাদিসের শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে ১৯৮৪ সালে এটি স্থাপিত হয়। বর্তমানে মাদ্রাসাটি আলোকিত মানুষ তৈরির কারখানা হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে। প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে বর্তমান পর্যন্ত হাজারো শিক্ষার্থী এ প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করে সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত আছেন। ভালো ফলাফলের কারণে ইতিমধ্যে মাদ্রাসাটি বেশ কয়েকবার উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান এবং এ মাদ্রাসার সুপার শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান প্রধানও নির্বাচিত হন। তবে এ সাফল্যের অন্তরালে প্রতিষ্ঠানটিতে রয়েছে শিক্ষক, শ্রেণী কক্ষ, কর্মচারী, বেঞ্চ ও খেলার মাঠ সংকট। বেঞ্চ সংকটের কারণে ক্লাশে গাদাগাদি করে বসতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। মোট কথা শিক্ষক, কর্মচারী ও আসবাবপত্র সংকটের কারণে পাঠদানে ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। এতে পাঠদানে দারুন ব্যঘাত ঘটছে। নানা সংকটের মধ্য দিয়েও খুঁড়িয়ে খুঁড়িযে চলছে মাদ্রাসাটির কার্যক্রম। সংকট নিরসনে মাদ্রাসার শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক মহল সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সহ সরকারী-বেসরকারী সংস্থার পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপির সুদৃষ্টি কামনা করছেন।
জানা যায়, লামা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম আলহাজ¦ মো. আলী মিয়া ও লামা ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মরহুম মাওলানা মোঃ জাফর উল্লাহ লাইনঝিরি এলাকায় একটি মাদ্রাসা চালু করার উদ্যোগ গ্রহন করেন। এ দুই গুনি ব্যক্তির আহবানে সাড়া দিয়ে এলাকাবাসির সার্বিক সহায়তায় প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তীতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বীর বাহাদুরের সার্বিক তত্ববধানে উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম আলহাজ¦ মোহাম্মদ ইসমাইল, শিক্ষানুরাগী মো. অলি উল্লাহ, আব্দুল হাকিম ও মো. হানিফ ভান্ডারী দেখভালো করেন। এদের পরিচালনায় প্রতিষ্ঠানটি নতুন করে দাখিল স্তরে উন্নতি লাভ করে শিক্ষার আলো ছড়াতে শুরু করে। এরপর ২০১০ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ মাহাবু¦বুর রহমান পরিচালনা কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ২০২২ সালের শুরু থেকে কমিটির সভাপতির দায়িত্ব তুলে নেন পৌরসভার মেযর মোঃ জহিরুল ইসলাম। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক পরিচালিত হয়ে আসছে।
তবে এ মাদ্রাসায় ১৭ জন শিক্ষক থাকার নিয়ম থাকলেও এতে আছে ১০জন। এর মধ্যে সহকারী গণিত ১জন, শারীরিক শিক্ষক ১জন, তথ্য ও যোগাযোগ শিক্ষক ১জন, দাখিল ক্বারী ১জন, এবতেদায়ী ক্বারী ১জন এবং এবতেদায়ী মৌলভী ২জন নেই। এবতেদায়ী প্রধান মোহাম্মদ শাহ নেওয়াজ এর এমপিওতে জন্ম তারিখ ভূল থাকার কারণে এমপিও ভুক্তি হতে নাম বাতিল হয়ে যায়। কর্মচারী ৫ জনের মধ্যে অফিস সহকারী, নৈশ প্রহরী ও এমএলএসএস থাকলেও নিরাপত্তা কর্মী ও আয়া পদ শুরু থেকে খালি রয়েছে। সম্মিলিতভাবে সহকারী শিক্ষকরা বিভিন্ন বিষয়ে পাঠদান চালাচ্ছেন। বর্তমানে ১ম থেকে দাখিল পর্যন্ত এ মাদ্রাসায় প্রায় ৫০০ ছাত্র-ছাত্রী অধ্যায়নরত আছে। শিক্ষার্থী অনুসারে এখানে শ্রেণী কক্ষ সহ দরকার ১০-১২টি, কিন্তু আছে ৮টি। তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপির একান্ত প্রচেষ্টায় মাদ্রাসার জন্য শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর চারতলা বিশিষ্ট একটি একাডেমিক ভবন নির্মাণ কাজ শিঘ্রই শুরু হবে।
নানা সংকটের কথা স্বীকার করে প্রতিষ্ঠানটির সুপার মাওলানা মুহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, তৎকালীন সময়ের অধ্যক্ষ জাফর উল্লাহ’র সু-শিক্ষার ধারনা ও প্রচেষ্টা প্রতিষ্ঠানকে দ্রুত এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। পাশাপাশি সকলের প্রচেষ্টায় দানকৃত ১৮শতক সহ মাদ্রাসার নিজস্ব অর্থায়নে ক্রয়কৃত ১২শতক সহ মোট ৩০শতক জমির উপর প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানটি ২০০৪ সালের ১ মে এমপিও ভুক্ত হয়। এর আগে মাদ্রাসার শিক্ষকরা ১০ বছর বিনা বেতনে পাঠদান করেন। মাদ্রাসাটি শিক্ষা দীক্ষায় অনগ্রসর দুর্গম পাহাড়ী এলাকা হওয়ার পরও জে.ডি.সি ও দাখিল সাধারণ পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করে আসছে। এছাড়া এলাকার নিম্ম আয়ের পরিবারের শিক্ষা বিমুখ সন্তানদের শিক্ষা লাভের অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টিতে বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শুরু থেকে উদার ও আন্তরিকতার পরিচয় দিয়ে আসছেন। শুধু তাই নয়, শিক্ষকরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে দরিদ্র পরিবারের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ সৃষ্ঠি করে চলেছেন। অনেক ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষকদের আর্থিক সহায়তা ও একান্ত প্রচেষ্টায় লেখাপড়া শিখে কর্মজীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তিনি আরও বলেন, শিকষক সংকট নিরসনে এনটিআরসি’তে ৩-৪ বার চাহিদা প্রেরণ করা হয়েছে। চাহিদা মতে নিয়োগ প্রদান করা হলে সংকট নিরসন হবে। তিন কক্ষ বিশিষ্ট একটি দ্বিতল ভবন সম্প্রসারণ, মাদ্রসার নিজস্ব অর্থায়নে নতুন ভবনের জন্য জায়গা কেনা সহ শিক্ষক কর্মচারীদের প্রতিদিনের আপ্যায়ন খরচ বহন করে এক উদার মানবিকতার পরিচয় দেন পৌরসভার মেয়র মো. জহিরুল ইসলাম। এ মানবিকতায় শিক্ষক কর্মচারীরা মেয়রের প্রতি কৃতজ্ঞা প্রকাশ করেন। মাঠ সংকটের কারণে খেলাধূলায় পিছিয়ে আছে এ মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা।
এদিকে শ্রেণী কক্ষ সংকটের বিষয়ে মাদ্রাসার দাখিল শিক্ষার্থী ছাত্র আরাফাত হোসেন, মো. নাছির উদ্দিন ও রোকসানা আক্তার এবং অভিভাবক সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘ দুই যুগ ধরে প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষার আলো ছড়ালেও নেই পর্যাপ্ত শ্রেণী কক্ষ, তার মধ্যে আবার নেই পর্যাপ্ত বসার বেঞ্চও। তাই এক বেঞ্চে গাদাগাদি করে বসতে হয় ৫-৭জন। এছাড়া বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষক না থাকায় পাঠদানে দারুন ব্যাঘাত ঘটছে বলেও জানান শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষক সংকটের কথা স্বীকার করে মাদ্রাসার সহকারী সুপার মাওলানা মোহাম্মদ ইলিয়াছ ও সহকারী মৌলভী মোজাম্মেল হক এক সূরে বলেন, প্রাথমিক থেকে দাখিল ১০ম শ্রেণি নিয়ে ক্লাশ পরিচালনা করা শিক্ষক স্বল্পতার জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। এ সংকটের মধ্যেও প্রতিদিন নিয়মিত ক্লাশ পরিচালনা করা হয়ে থাকে। ফলে শিক্ষকদের জন্য প্রতিষ্ঠান চলাকালে বিশ্রামের সুযোগ থাকেনা।
এদিকে পৌরসভার ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. ইউছুপ জানায়, এলাকার ছেলে মেয়েদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলার মহান উদ্দেশ্য নিয়ে মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শুরু থেকেই শিক্ষক-শিক্ষিকা, পরিচালনা কমিটি ও অভিভাবকদের সাথে রয়েছে পারস্পারিক সহযোগীতা ও সহমর্মিতা। সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টায় এটি দিনের পর দিন শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। তবে কিছু সংকটের কারণে মাদ্রাসায় পাঠদানে ব্যঘাত ঘটছে বলে শুনেছি। এ সংকট নিরসন করা দরকার।
মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও পৌরসভার মেয়র মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, এ মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষিকারা পাঠদানে খুবই আন্তরিক। যার কারণে এলাকায় ধর্মীয় শিক্ষার আলো ছড়িয়ে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। তিনি আরও বলেন, ২০২২ সালে সভাপতির দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে সকলকে সাথে নিয়ে মাদ্রাসাটির উন্নয়নে নিরলস ভাবে কাজ করে চলেছি। পৌরসভার উদ্যোগে সম্প্রতি ১৪ লক্ষ টাকা ব্যয়ে দ্বিতল ভবন সম্প্রসারণ করা হয়েছে। শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাধ্যমে চারতলা বিশিষ্ট একাডেমিক ভবন নির্মাণ কাজ কয়েক মাসের মধ্যে শুরু হবে। এটি বাস্তবায়ন হলে শ্রেণী কক্ষ সংকট থাকবেনা। এছাড়া পৌরসভার পক্ষ থেকে আগামী অর্থ বছরে খন্ড কালীন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার পরিকল্পনা আছে, এত কিছুটা হলেও সংকট লাঘব হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বীর বাহাদুরের সদ্বিচ্ছায় অচিরেই মাদ্রাসাটির সব সংকট নিরসন হবে বলেও মন্তব্য করেন মেয়র জহিরুল ইসলাম।
এ বিষয়ে বান্দরবান জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ফরিদ উল্ আলম হোসাইনী জানায়, গত দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে লাইনঝিরি মোহাম্মদীয়া ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রসাটি এলাকায় শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে। মাদ্রাসাটি বেশ কযেকবার উপজেলা পর্যায়ে প্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও নির্বাচিত হয়। কিন্তু মাদ্রাসায় শিক্ষক, কর্মচারী, শ্রেণী কক্ষ ও বেঞ্চ সংকট থাকায় পাঠদান কার্যক্রমে ব্যঘাত ঘটছে। শিক্ষক সংসকট নিরসনে এনটিআরসিকে অবহিত করা হবে। এনটিআরসি কর্তৃক নিয়োগ শিক্ষক নিয়োগ করা হলে সংকট নিরসন হবে। অন্য সমস্যাগুলো সমাধানেও সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপ জরুরী।
প্রধান সম্পাদক : বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রিয়দর্শী বড়ুয়া, প্রকাশক : প্রদীপ কান্তি দাশ, সম্পাদক : মো. নুরুল করিম আরমান, আইন বিষয়ক উপদেষ্ঠা : এ্যডভোকেট ফয়সাল আজিজ।
সম্পাদকীয় কার্ষালয় : প্রেসক্লাব ভবন (দ্বিতীয় তলা), প্রধান সড়ক, লামা পৌরসভা, বান্দরবান
ই-মেইল paharerkatha@gmail.com, মোবাইল: ০১৭৫০৪৪৪৯৯৬/০১৮১৪৮৪৫০৭৩
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত