লামা প্রতিনিধি |
পৃথিবীর লৌহদন্ড বলা হয় পাহাড়কে। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় যার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। এর ওপর ভর করেই প্রকৃতি তার ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। অথচ একশ্রেণির ভূমিদস্যু নিজেদের স্বার্থ হাসিলে সেই পাহাড়কে একের পর এক সাবাড় করে দিচ্ছে। এমনিই একটি ঘটনা ঘটেছে বান্দরবানের লামা উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের ইয়াংছা-ঈদগড় সড়কের রাজাপাড়া সংলগ্ন সড়কের পূর্বপাশে। পাহাড়ের উপর সৃজিত কয়েক হাজার কলাগাছ নিধন করে পাহাড় কেটে সাবাড়ের ঘটনাটি ঘটিয়েছেন অর্পণ মহাজন নামের এক ব্যক্তি। এর আগেও তিনি পাশের আরেকটি পাহাড় কেটে সাবাড় করেছেন। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী পাহাড়কাটা অবৈধ হলেও এর তোয়াক্কা করেননি তিনি।
জানা যায়, জনৈক ইমারত হোসেন নামের এক ব্যক্তির নামে লামা উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের বনপুর এলাকায় প্রায় ৭২ কানি জায়গাজুড়ে পাহাড় রয়েছে। এ পাহাড় লিজ নেন চকরিয়া উপজেলার বাসিন্দা মৃত রাজেন্দ্র লালের ছেলে অর্পণ মহাজন। পরবর্তীতে তিনি এর মধ্যে কিছু জায়গা ৭ হাজার টাকায় স্থানীয় বনপুর এলাকার জয়নাল আবেদীন ও ৩০ হাজার টাকায় বেবী রানী দে’র কাছে ৪ বছরের জন্য লাগিয়ত দেন। লাগিয়ত নেওয়ার পর জয়নাল আবেদীন ও বেবী রানী দে ওই পাহাড়ি জায়গায় কলা বাগান করেন। বাগানে প্রায় দুই হাজারেরও বেশি কলা চারা রোপণ করেন লাগিয়তপ্রাপ্তরা। কিন্তু বছর যেতে-না যেতেই অর্পণ মহাজান ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে এক্সকেভেটর লাগিয়ে ওই পাহাড় কেটে সাবাড় করে দেয়। এতে লাগিয়তপ্রাপ্তদের প্রায় দুই লক্ষাধিক টাকার ক্ষতি হয়। গত ৮-১০ দিন ধরে দিনে-রাতে সমানতালে একের পর এক পাহাড় কেটে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে তৈরি করেন সমতল ভূমি। দীর্ঘদিন ধরে পাহাড় কাটা অব্যাহত রাখলেও এ যেন দেখার কেউ নেই। এতে স্থানীয়দের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, সড়কের পূর্বপাশে রাজাপাড়া সংলগ্ন স্থানে এক্সকেভেটর লাগিয়ে সুউঁচ্চ পাহাড় কেটে পাশ দিয়ে বয়ে চলা ঝিরি ভরাট করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়. সেখানে দেখা গেল ফলন্ত কলা বাগান নিধনের কর্মযজ্ঞও। প্রায় দুই একর উঁচু-নিচু সবুজ অরণ্য ঘেরা পাহাড় কেটে ঝিরি ভরাট করে সমতল ভূমি তৈরি করেছে অর্পণ মহাজন। এ সময় ভুক্তভোগী বেবী রানী দে বলেন, ‘আমি গরীব ও অসহায়। ভিটেমাটি পর্যন্ত নাই। অন্যের ঘরে থাকি। এর মধ্যে নিজের জীবন জীবিকার জন্য একটি বেসরকারি এনজিও থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে কলা বাগান করার জন্য অর্পণ মহাজন থেকে পাহাড়ি জায়গা লাগিয়ত নিয়েছিলাম। কথা ছিল ২০২২ সাল থেকে আগামী ৪ বছর পর্যন্ত লাগিয়তপ্রাপ্ত জায়গা ভোগ করবো। সে মতে আমি ওই জায়গায় আরও কিছু ঋণ নিয়ে প্রায় এক হাজারেরও বেশি কলা চারা রোপণ করি। এতে প্রায় আরও লক্ষাধিক টাকা খরচ হয়। এখন ফলন আসার সময়। কিন্তু এর মধ্যে অর্পণ মহাজন কোন ধরনের কথাবার্তা ছাড়া আমার রোপিত ফলন্ত কলাগাছগুলো এক্সকেভেটর লাগিয়ে নিধন করে পাহাড় কেটে সাবাড় করে দিয়েছে। এখন আমি ঋণের টাকাগুলো কিভাবে শোধ করবো। আমার এখন মরণ ছাড়া আর কোন উপায় থাকলো না। আমি আমার ক্ষতিপূরণ চাই।’
একই কথা জানালেন আরেক ক্ষতিগ্রস্ত জয়নাল আবেদীনও। তিনি বলেন, ‘আমি ক্ষতিপূরণ চেয়ে স্থানীয় ইউপি সদস্য বরাবরে অর্পণ মহাজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার কারণে এখন তার ছেলে আমাকে মারার জন্য হুমকি দিচ্ছেন।’
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে অর্পণ মহাজন বলেন, ‘আমি পাহাড় কাটিনি। উঁচু নিচু জায়গা সমান করেছি মাত্র।’
দীর্ঘদিন ধরে পাহাড় কাটা অব্যাহত থাকলেও প্রশাসন কিংবা পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন স্থানীয়রা। তারা এ ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
এ বিষয়ে ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য মংমেগ্য মার্মা জানান, ‘অর্পণ মহাজন কর্তৃক লাগিয়রপ্রাপ্তদের ক্ষতিপূরণ না দিয়ে জোরপূর্বক কলাগাছ ও পাহাড় নিধনের ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক। এটা মেনে নেওয়া যায় না।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন কমিটির লামা উপজেলা শাখার সভাপতি এম. রুহুল আমিন জানান, ‘বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী পরিবেশ সুরক্ষায় পাহাড় কাটা নিষেধ। অথচ এ আইন কেউ মানছেন না। অপরিকল্পিতভাবে পাহাড়কাটার কারণে প্রতি বর্ষা মৌসুমে উপজেলায় বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসে। এতে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। প্রশাসনিকভাবে পাহাড়কাটা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় এমনটি চলছে। অবিলম্বে পাহাড় খেকোদের অপতৎপরতা বন্ধ করা না গেলে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে।’
তবে পরিবেশ অধিদপ্তর বান্দরবান জেলার উপ-পরিচালক ফখর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘লামা উপজেলার বনপুর এলাকায় অর্পণ মহাজন কর্তৃক পাহাড় কেটে সাবাড়ের অভিযোগ পেয়েছি। পাহাড় কেটে পরিবেশ ধ্বংসকারীকে কোন ছাড় নয়। ঘটনাস্থলে দ্রæত অভিযান পরিচালনা করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
প্রধান সম্পাদক : বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রিয়দর্শী বড়ুয়া, প্রকাশক : প্রদীপ কান্তি দাশ, সম্পাদক : মো. নুরুল করিম আরমান, আইন বিষয়ক উপদেষ্ঠা : এ্যডভোকেট ফয়সাল আজিজ।
সম্পাদকীয় কার্ষালয় : প্রেসক্লাব ভবন (দ্বিতীয় তলা), প্রধান সড়ক, লামা পৌরসভা, বান্দরবান
ই-মেইল paharerkatha@gmail.com, মোবাইল: ০১৭৫০৪৪৪৯৯৬/০১৮১৪৮৪৫০৭৩
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত