সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, গজালিয়া ইউনিয়নের ৮ ও ৯নং ওয়ার্ডের দূর্গম পশ্চিম বটতলী পাড়া বমুখালের এক পারে বটতলীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ৭০টি বসতি পরিবার। অন্য পারে রয়েছে পূর্ববটতলীপাড়া, তুলাতলী হামিদচর পাড়া, তুলাতলী মুরুং পাড়া, চিন্তাবরপাড়াসহ ৯টি পাড়ার প্রায় ৫ হাজার পাহাড়ী-বাঙ্গালী জনবসতি। প্রতিদিন দুই শতাধিক শিক্ষার্থীসহ শহস্রাধিক লোকজন এই ঝুঁকিপূর্ণ খাল পার হয়ে বিদ্যালয়ে ও বটতলীবাজার-গজালীয়া বাজারে যাতায়াত করে আসছে দীর্ঘদিন।
শিশু শিক্ষার্থীরা খালে নামার আগ থেকে আতঙ্কে থাকে। তবুও ফিরতে হবে স্কুল কিংবা বাড়ীতে। ৮ থেকে ১০জন শিক্ষার্থী বাড়ী থেকে এসে খাল পার হচ্ছিল। দুই-একজন ক্লান্তও, নিচ্ছিল দম। একপর্যায় চোখের আন্দাজে প্রায় ৪০ ফুট চওড়া খালটি কোমর পানিতে পার হয় সবাই। তীরে উঠেই রোদে দেয় ভেজা জামা- কাপড়। গায়ে পড়ে স্কুলড্রেস। অবশেষে বই-খাতা নিয়ে ছোঁটে স্কুলে।
স্থানীয় বাসিন্দা মো. ছগির উদ্দিন বলেন, গত ১৫ নভেম্বর শীতের এই সময়ে শীতল পানিতে দুই শিশু সাঁতার কেটে পশ্চিম পাড়া আসছিলো। কিন্তু খালের মাঝখান থেকে নাজিম উদ্দিন নামে ১০ বছরের এক শিশু ভেসে যায়। সাথে থাকা শিশুটির চিৎকারে পার্শ্ববর্তী লোকজন এগিয়ে এসে প্রায় তিনশতফুট দূর থেকে ভেসে যাওয়া শিশুটি উদ্ধার করে।
বটতলী পাড়ার গ্রাম সর্দার মোঃ মনির উদ্দিন বলেন, আমাদের কাছে এই দৃশ্য নতুন কিছু নয়। ৪০ ফুট চওড়া এ খাল পার হতে কোন সেতু নেই। নৌকা পারাপারেও নেই কোন স্থায়ী ব্যবস্থা। বাধ্য হয়ে খাল সাঁতরে স্কুলে যায় ওরা। দীর্ঘবচর ধরে এ অবস্থা চললেও খালে সেতু নির্মাণের জন্য কোন উদ্যোগ স্থানীয় প্রশাসন নিয়েছে কিনা আমরা জানিনা। তবুও জীবনবাজি রেখে এখানকার ৯টি পাড়ার প্রায় ৪ হাজার মানুষ ও ২শতাধিক শিক্ষার্থী এভাবে খাল সাঁতরে স্কুলে আসা-যাওয়া করে। এ ছাড়া গত বছর বটতলী তালগাছতলা দুই পাড়ের একমাত্রা ঘাটটি খালের ভাঙ্গনে ভেঙ্গে যায়। ফলে বর্তমানে ঝুঁকি নিয়ে মানুষ এখন পাড়ের ভাঙ্গা অংশে খাঁড়া পথ দিয়ে চলাচল করছে।
চতুর্থ শ্রেণী পড়ুয়া শিশু শিক্ষার্থী রোকশানা আক্তার (৯) বলেন, আমার বাড়ি তুলাতলী হামিদ চর পাড়া গ্রামে। পড়ালেখা করি বটতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। দুই পাড়ার মাঝখানে বয়ে যাওয়া বমু নামক এই খাল সাঁতরে আমার যেতে হয় স্কুলে। রোকশানা আক্তার আরো বলেন, ‘স্যার খাল পার হতে আমাদের অনেক ভয় হয়। আমরা অনেক কষ্ট করি স্যার। শিশু শ্রেণী থেকে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত অনেক কষ্ট করছি। এখনও এক বছর কষ্ট করা লাগবে। দুই তিনদিন আগে পানির স্রোতে পড়েছি। এ স্রোতে বিশহাতের মতো ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আমি অনেক কান্না করছি। কেউ ছিল না। পরে আমি আস্তে আস্তে কিনারে এসেছি। বই খাতা ভিজে গেছে। এখনও শুকায়নি।’ রোকশানার মত ওই স্কুলের তৃতীয় শ্রেণী পড়া শফিকুল ইসলাম, আনিশা আক্তার, পঞ্চম শ্রেণীর মোঃ রাহান মিয়াও বলেন, ‘খাল সাঁতরে স্কুলে যেতে ভয় করে ওদের। কষ্ট হয় এই শীতে খাল পার হতেও।’ তাই শিশু শিক্ষার্থীদের দাবি খালটিতে একটি সেতু নির্মাণের।
এক শিক্ষার্থীর অভিভাক বটলী পাড়া গ্রামের শামসুল হক বলেন, ‘আমার দুই ছেলে এই স্কুলে পড়ে। সপ্তাহখানেক আগে আমার এক ছেলে খাল পার হতে গিয়ে খালের কুমে পরছিলো, আমি এসে উঠিয়ে স্কুলে পৌঁছে দিয়েছি। এই দুই ছেলেকে স্কুলে আনা-নেওয়া করতে আমার অনেক কষ্ট হয়। বমুখালের উপর একটি অন্তত ছোটখাটো সেতু হলে ভাল হয়। ব্রিজ হলে ছেলে মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে কোন অভিভাবক না করবেনা।
বটতলী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি দাশ বলেন, বর্তমানে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী রয়েছে ৮০জন। খাল পারাপারের ভয়ে বেশি সংখ্যক অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠায়না। খালের পূর্বপারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠায় তাদের। এ ছাড়া, বটতলী থেকে একটএ দূরে গজালিয়া উচ্চ বিদ্যায়ের শিক্ষার্থীসহ মোট দুইশত শিক্ষার্থী প্রতিদিন এ খাল পার হয়ে বিদ্যালয় যায়। অনেক অভিভাবকই এই ঝুঁকি নিয়ে ছেলে মেয়েদের বিদ্যালয়ে আসতে দেয় না। যদি স্কুলের পূর্ব পাশের এই খালে একটি ব্রিজ হতো, তাহলে শিশু শিক্ষার্থীরা এই ঝুঁকি থেকে রেহাই পেত। এই শীতের সময়ে শিক্ষার্থীদের অনেক কষ্ট হয়। অনেকেই প্রায় পাঁচ কিলোমিটার ঘুরে স্কুলে আসে। অনেকে নিয়মিত স্কুলেও আসতে পারে না।
এলজিইডির লামা উপজেলা প্রকৌশলী আবু হানিফ বলেন, ‘শিশু শিক্ষার্থী এবং জনস্বার্থে ওই খালের ওপর ব্রিজ (সেতু) নির্মাণ জরুরি ছিলো। তাই আমরা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে এ বিষয়ে ২০২৪ সালে বটতলী ও পূর্ব বাইশফাঁড়িতে ব্রিজ স্থাপনের জন্য প্রস্তাবনা পাঠিয়েছি।’
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মঈন উদ্দিন বলেন, শিক্ষার্থী ও জনসাধারণের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে স্কুলগামী ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা যাতে স্বাভাবিক চলাচল করতে পারে সে জন্য এলজিইডি লামা সরেজমিনে খাল পরিদর্শন করে গত বছর দুইটি স্থানে ব্রিজ স্থাপনের জন্য প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।












প্রধান সম্পাদক : বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রিয়দর্শী বড়ুয়া,
সম্পাদক : মো. নুরুল করিম আরমান,
আইন বিষয়ক উপদেষ্ঠা : এ্যডভোকেট ফয়সাল আজিজ