মো. নুরুল করিম আরমান |
সুন্দর এ পৃথিবীতে কারো বেঁচে নেই বাবা, আর কারো নেই মা, আবার কারো বাবা, -মাকে ছেঁড়ে অন্যের সাথে সংসার পেতেছেন। অভাবী সংসারে সেই হতভাগী মায়ের ক্ষমতাও নেই সন্তানকে লেখাপড়া করাবে, মানুষের মত মানুষ করবেন। বড় হয়ে যাতে সন্তান নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। লেখাপড়া চালানো দুরের কথা, সংসারে ছোট্ট ছোট্ট শিশু সন্তানদের মুখে দুমোটে খাবার তুলে দিতেও হিমশিম খাচ্ছেন অনেকের পরিবার। অথবা বাবা-মা ও আত্মীয়-স্বজন কেউই নেই; অগত্য এমন পরিবারের অনাথ শিশুদের ঠাঁই এখন বান্দরবান জেলার লামা উপজেলায় গড়ে উঠা ‘সাঙ্গু অনাথ সংঘে’। উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের দুর্গম পাহাড়ি এলাকার রাজাপাড়ায় অনাথ সংঘটির অবস্থান। এ অনাথ সংঘে ঠাঁই পাওয়া শিশুদের ৫ বছর ধরে নিজেদের বেতনের টাকায় লালন-পালন করছেন অংক্যমং মার্মা ও রুপালী ত্রিপুরা নামের এক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি দম্পত্তি। অংক্যমং মার্মা ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের রামথুই পাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরি। আর সহধর্মীনি রুপালী ত্রিপুরা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ সহকারী। অংক্যমং মার্মা ত্রিশডেবা পাড়ার বাসিন্দা মৃত মংবাথোয়াই মার্মার ছেলে। বর্তমানে সংঘে শিশুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় খাবার ও শিক্ষা উপকরণ সংকট দেখা দিয়েছে। এ সংকটের সময় হৃদয়বান এ দম্পত্তিকে অনাথ শিশুদের সহযোগিতার হাত না বাড়ালে সমাজে অসহায় অনাথদের আশ্রয়ে কেউ এগিয়ে আসবেনা বলে জানান স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
জানা গেছে, বড় হতে গিয়ে সমাজে অনেক শিশুকে অভিভাবকহীন অবহেলিত জীবন দেখছেন। অভিভাবকহীন অনেক শিশুকে বিপথে চলে যেতে দেখেছেন। এ থেকে সমাজের অবহেলিত ও অভিভাবকহীন শিশুদের জন্য কিছু করার স্বপ্ন জাগে অংক্যমং মার্মার। এ ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালের শেষের দিকে ৫ অনাথ শিশুকে নিয়ে দুই কক্ষ বিশিষ্ট বাঁশের বেড়া ও টিনের চাউনি ঘরে ‘সাঙ্গু’ নামে অনাথ সংঘটি গড়ে তোলেন তিনি। বর্তমানে সেখানে ৩২জন ছেলে-মেয়ের বসবাস। এসব শিশুদের থাকা-খাওয়া, ভরণ ও পড়াশোনার যাবতীয় খরচ জোগানের পাশাপাশি মা-বাবার আদর দিয়ে শিশুদেরকে আগলে রাখছেন এ দম্পত্তি। প্রতিবছর এখান থেকে পড়ালেখা করে উচ্চ শিক্ষার সুযোগও পাচ্ছে দুর্গম পাহাড়ি এলাকার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির অবহেলিত শিশুরা। সকাল-সন্ধ্যা দু’বেলা শিশুদের পড়াশোনা করান অংক্যমং মার্মা ও তার সহধর্মীনি রুপালী ত্রিপুরা। একই সঙ্গে তারা যেসব শিশুর বিদ্যালয়ে যাওয়ার বয়স হয়নি তাদেরও হাতেখড়ি দেন।
অংক্যমং মার্মা বলেন, সাঙ্গু অনাথ সংঘে থাকার প্রথম শর্ত হলো অনাথ ও অসহায় হতে হবে। তবে কোনও শিশুর বাবা-মা দুজনের একজন যদি মৃত হন এবং সন্তানের ভরণপোষণ চালাতে অক্ষম হন, তাহলে তাদেরকেও অনাথ সংঘে রাখা হয়। শিশুদের নিরাপত্তার ব্যাপারে অংক্য মং মার্মা বলেন, ‘লেখাপড়ার জন্য নিরিবিলি পরিবেশ, রয়েছে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ক্লাসের বই পড়া ছাড়াও ছবি আঁকা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, ছোট গল্প, উপন্যাস ও গুণীজনদের জীবনী পড়ার প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় এ অনাথ সংঘে। সৃষ্টি কর্তার কৃপায় কখনও কোনও সমস্যা হয়নি। তবে দিন দিন শিশু বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে খাবার, ভরণ পোষন ও শিক্ষা উপকরন যোগান দিতে হিমসিম খেতে হচ্ছে। অংক্যমং মার্মার সহধর্মিনী রুপালী ত্রিপুরা জানায়, অনাথ শিশুদের জন্য তিন বেলার রান্না তিনি নিজেই করেন। আবার তারা একসাথে খাওয়া দাওয়াও করেন অনাথদের সাথে। দম্পত্তির জন্য আলাদা রান্না করা হয়না। নিজের ছেলে-মেয়ের মত করে অনাথ শিশুদের মানুষ করার চেষ্টা করছেন বলেও জানান রুপালী ত্রিপুরা।
সরেজমিন পরিদর্শনে গেলে অনাথ সংঘে থাকা শিশু মেনচং মুরুং, ক্রাতপুং মুরুং, থমপং মুরুং ও উখিংছাই মার্মা সহ অনেকে জানায়, ‘আমাদের বাবা-মা নেই। আমরা এখানে ভালো আছি। আদর-যতœ করেন আমাদের অংক্য মং মার্মা স্যার। তার সেবা ও ভালো শিক্ষা পেয়ে আমরা খুশি। অতীতের সব দুঃখ ভুলে গেছি।
অনাথ সংঘে থাকা ছাইন ও চোলইন এর বাবা নেই। তাদের মা থুই ইয়ই বলেন, ‘স্বামী মারা যাওয়ার পর অভাবের সংসারে তিন ছেলে-মেয়েকে নিয়ে চরম কষ্টে দিন যাচ্ছিল। হঠাৎ একদিন জানতে পারি রাজাপাড়ায় সাঙ্গু নামে একটি অনাথ সংঘ আছে। খবর নিয়ে সাঙ্গু অনাথ সংঘে ছেলে-মেয়েকে রেখে আসি। সেখানে তারা এখন খুব ভালো আছে, লেখাপড়া করছে। আমি প্রাণভরে অংক্য মং মার্মার জন্য দোয়া করি সবসময়।’
রামথুই পাড়ার ক্যএচিং মার্মা বলেন, ২০১৯ সাল থেকে ৪ বছর আমি সাঙ্গু অনাথ সংঘ -এ ছিলাম। এখন আমি বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনে পড়ি। বাবা প্রতিবন্ধি হওয়ার পর মায়ের হাত ধরে সাঙ্গু অনাথ সংঘে গেছি। আমার মতো অনেক শিশু সেখানে থেকে লেখাপড়া করে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পেয়েছে। আমরা সবাই আমাদের অভিভাবক অংক্যমং স্যারের জন্য দোয়া করি।
অংক্যমং মার্মা বলেন, ‘এ পর্যন্ত সাঙ্গু অনাথ সংঘে থেকে পড়াশোনা করে এখন অন্যত্র পাড়ালেখা করছেন ৫০-৬০জন শিশু। অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের গড়ে তোলাই আমার উদ্দেশ্য। তিনি বলেন, ‘দুর্গম পাহাড়ের শিশুরা প্রাথমিকের সিঁড়ি পেরিয়ে মাধ্যমিকে যাওয়ার আগেই ঝরে পড়ে। অভাব-অনটনের মধ্যে কোনও রকমে শিক্ষিত হলেও ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারে ঢেকে যায় জীবন। সমাজে তাদের প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি।’
সাঙ্গু মৌজা হেডম্যান ও অনাথ সংঘ পরিচালনা কমিটির সভাপতি চংপাত ¤্রাে জানিয়েছেন, অংক্যমং মার্মা ও তার স্ত্রীর সব টাকা অনাথ শিশুদের জন্য খরচ করেন। পৈতৃক সহায়-সম্পত্তিও ব্যয় করছেন অনাথ শিশুদের পেছনে। সাঙ্গু অনাথ সংঘে শিশুদের পড়াশোনা ও যাবতীয় খরচ মাসে ৫০-৬০ হাজার টাকা। বর্তমানে শিশুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় খাবার ও শিক্ষা উপকরণ সংকট দেখা রয়েছে। মাঝে মধ্যে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ ও উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক সহযোগিতা করা হলেও তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।
এদিকে সাঙ্গু অনাথ সংঘের অংক্যমং মার্মা ২০২৪ সালের ডিস্মেবর মাসে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা’র সাথে দেখা করে অনাথ সংঘের দুর্দশার কথা তুলে ধরেন। এ সময় অংক্যমং মার্মার অসহায়ত্ব দেখে সংঘের জন্য একটি ৩ কক্ষ বিশিষ্ট ভবন নির্মাণের জন্য বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানকে সুপারিশ করেন। বর্তমানে জেলা পরিষদের অর্থায়নে সংঘ ভবনের কাজ চলমান। তবে বর্তমানে শিশুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন ভবন নির্মাণ হলেও আরও দুটি কক্ষের প্রয়োজন রয়েছে বলে জানান অংক্য মং মার্মা।
এ বিষয়ে ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য মংমেগ্য মার্মা ও ত্রিশডেবা পাড়া কারবারী অংক্য মার্মা এক সূরে বলেন, সমাজে অনেক বিত্তশালী মানুষ আছেন। যারা এসব কাজে অর্থ ব্যয় করেন না। অথচ অংক্যমং মার্মা দম্পত্তি নিজের বেতনেরন টাকার উপর ভর করে মা-বাবার দায়িত্ব নিয়ে অনাথ শিশুদের আলোকিত করে তুলছেন। এটি মহতী উদ্যোগ। অনাথদের এগিয়ে নিতে তার ভূমিকা উদাহরণ হয়ে থাকবে। বর্তমানে অনাথ সংঘে শিশু বৃদ্ধির কারনে সংকট দেখা দিয়েছে। তার এই কাজে সবাইকে সহায়তার হাত বাড়ানো উচিত। একই কথা জানান ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মো.জাকের হোসেন মজুমদার। তিনি জানান, মাঝে মধ্যে বনপুর এলাকায় যাওয়া হলে অংক্যমং মার্মার অনাথ সংঘ যাই। সুযোগ হলে অনাথ সংঘের শিশুদের জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিবো।
তবে সমাজসেবা অধিদপ্তরের বান্দরবান জেলার উপ-পরিচালক মিল্টন মোহরী জানান, সাঙ্গু অনাথ সংঘ’র নাম শুনেছি। প্রতিষ্ঠানটি এখনো সমাজসেবা অধিদপ্তরে রেজিষ্ট্রেশন করার জন্য আবেদন করেনি বিধায় সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেনা। জেলা প্রশাসকের অনুমতি সাপেক্ষে আমাদের দপ্তরের রেজিষ্ট্রেশনভুক্ত হলে ‘সাঙ্গু অনাথ সংঘ’ ক্যাপিটেশন গ্রান্ড সুবিধা পাবে। এতে অংক্যমং মার্মা দম্পত্তির উপর আর্থিক চাপ কমে যাবে বলেও জানান এ কর্মকর্তা।
প্রধান সম্পাদক : বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রিয়দর্শী বড়ুয়া, প্রকাশক : প্রদীপ কান্তি দাশ, সম্পাদক : মো. নুরুল করিম আরমান, আইন বিষয়ক উপদেষ্ঠা : এ্যডভোকেট ফয়সাল আজিজ।
সম্পাদকীয় কার্ষালয় : প্রেসক্লাব ভবন (দ্বিতীয় তলা), প্রধান সড়ক, লামা পৌরসভা, বান্দরবান
ই-মেইল paharerkatha@gmail.com, মোবাইল: ০১৭৫০৪৪৪৯৯৬/০১৮১৪৮৪৫০৭৩
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত