সুফল চাকমা, বান্দরবান |
সবুজ পাহাড় এখন সোনালি রঙে রঙিন। যেদিকে দুই চোখ যায় শুধু ভেসে ওঠে পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে থাকা জুমের পাকা সোনালি রঙের ধান। কেউ ধান কাটা শুরু করেছেন, কেউ-বা আবার পাকা ধান পাহারা দিতে সপরিবারে জুমক্ষেতে উঠেছেন। এ ছাড়াও অনেকেই ধান কাটার আগে সঙ্গী ফসল মিষ্টি কুমড়া, ভুট্টা, মারফা ও চিনাল সংগ্রহ করেছেন। তিন পার্বত্য জেলায় বিশেষ করে দুর্গম এলাকায় এখন জুমচাষিদের দম ফেলার ফুসরত নেই। চারদিকেই বিরাজ করছে উৎসবমুখর পরিবেশ।
বান্দরবানের জেলা শহর থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে থানচি উপজেলা বলিপাড়া ইউনিয়নের এলাকায় গত রবিবার সরেজমিনে দেখা যায়, দিনতে ম্রোপাড়ার বাসিন্দা জুমচাষি দৈ লাং ম্রো (৫৮) সপরিবারে দলবল নিয়ে জুমের পাকা ধান কাটছেন। ধান কাটতে কাটতে তিনি জানান, এ বছর ১২ কানি জায়গায় (১ কানি=৪০ শতক) ১২ আড়ি ধানের জুম করতে পেরেছেন। (১ আড়ি=১০ কেজি)। তবে কিছুটা আফসোস করে তিনি জানান, এ বছর জুমের ধান তেমন ভালো হয়নি, কারণ যখন বৃষ্টির দরকার ছিল তখন বৃষ্টি হয়নি, আর যখন রোদ দরকার তখন অতিবৃষ্টি। তারপরও ৪০০ আড়ি ধান পাওয়ার আশা করছেন তিনি। যদি ফলন ভালো হতো তাহলে ৬০০ আড়ি ধান পেতেন। তবে সঙ্গী ফসল দিয়ে ক্ষতি অনেকটা পুষিয়ে যায়।
প্রতিবছর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে জুমের জায়গা নির্ধারণ করা হয়। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে জুমচাষের জন্য নির্ধারিত জায়গায় জঙ্গল কাটা হয়, তারপর কাটা জঙ্গল রোদে শুকানোর পরে মার্চ-এপ্রিলে কাটা জঙ্গল আগুনে পোড়ানো হয়। এপ্রিলজুড়েই জুমের জায়গা পরিষ্কার করে ধান বপনের জন্য প্রস্তুত করে কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টির জন্য অপেক্ষায় থাকেন চাষিরা। বৃষ্টি হলেই জুমের জায়গায় ধানসহ সঙ্গী ফসল বপন করা হয়। যারা বৈশাখ মাসের প্রথম বৃষ্টির পর জুমে ধানসহ সঙ্গী ফসল বপন করতে পারেন তাদের ধান আগে পাকা শুরু করে। প্রতিবছর আগস্ট মাসের শেষে অথবা সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে জুমের ধান কাটা শুরু হয়। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর পর্যন্ত জুমের ধান কাটা, মাড়াই ও শুকানো প্রক্রিয়া চলে। ধান শুকানো শেষে জুমঘর থেকে মূলঘরে ধান স্থানান্তর করার পর জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলে ঘরে ঘরে জুম ধানের নবান্ন উৎসব।
চাষিরা জানান, এক জায়গায় প্রতিবছর জুম চাষ করা যায় না। একবার এক জায়গায় জুম চাষ করার পর তিন থেকে ৫ বছর পর্যন্ত জায়গা ফেলে রাখতে হয় মাটি উর্বর হওয়ার জন্য।
জুমচাষে সরাসরি ধান বপন করা হয়। আবার ধানের সঙ্গে মিশ্র করে তুলা, ঠান্ডা আলু, যব, মিষ্টি কুমড়া, ভুট্টা, মারফা (শসাজাতীয় ফল), চিনাল (বাঙ্গিজাতীয় ফল), আমিলাগুলো বীজ (রোজেলা) বপন করা হয়। ধান বপন করার আগে মরিচ, তিল, বেগুন, সাবারাং (মসলাজাতীয় শাক), ধনিয়া পাতার বীজ, কাকন বীজ জুমের জায়গায় ছিটিয়ে দেওয়া হয়।
বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অফিস সূত্রে জানা যায়, বান্দরবান জেলার সাতটি উপজেলায় চলতি অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৭ হাজার ৯৩৩ হেক্টর জায়গায় জুমচাষ করা হয়েছে। এতে সম্ভাব্য উৎপাদন- চাল ১২ হাজার ৫৮ মেট্রিক টন, ধান ১৮ হাজার ৮৭ মেট্রিক টন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক এমএম শাহনেয়াজ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে জানান, বান্দরবানে এ বছরের শুরুতে বৃষ্টিপাত কম আবার শেষের দিকে অতিবৃষ্টি হওয়ার কারণে জুমের ঢালু জায়গায় জুমের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। আবার আগস্ট মাসে অতিবৃষ্টির কারণে সঙ্গী ফসলেরও একটু ক্ষতি হয়েছে। বান্দরবান জেলায় জুমচাষিদের ক্ষতির পরিমাণ দেড় কোটি টাকার মতো বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, জুমের ধান এখনও যেগুলো পাকেনি, শেষের ধানের ভালো ফলন হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
জুমের জায়গা নির্ধারণ নিয়ে বিশ্বাস
জুমচাষিরা মনে করেন, এই বিশাল বিশাল পাহাড়ের মালিক হচ্ছেন একেকজন দেবতা, তাই এই পাহাড়ে জুমচাষ করতে গেলে দেবতার অনুমতি নিতে হবে, অনুমতি দিলে জুমচাষ করা যাবে, না দিলে করা যাবে না। এটার ব্যতিক্রম হলে পরিবারের সদস্যদের অসুখ-বিসুখে ক্ষতি হয়, এমনকি পরিবারের সদস্যের মৃত্যুও হতে পারে বলে জানান বিভিন্ন এলাকার চাষিরা। এই অনুমতি নেওয়াটাও একটা বিশ্বাস।
একজন জুমচাষি একটা পাহাড় বা জায়গা ঠিক করে তিনি সেই জায়গা থেকে এক মুঠো মাটি নিয়ে আসেন। তারপর পাকপবিত্র মনে সেই এক মুঠো মাটি বালিশের নিচে রেখে নিয়ত করে ঘুমাবেন। অর্থাৎ রাতে যেন জুমের জায়গাটা সম্পর্কে ভালোমন্দ স্বপ্নে প্রাপ্ত হন। এই জুমের জায়গা নির্ধারণ সম্পর্কে প্রুমং উ হেডম্যানপাড়া নিবাসী ৭৬ বছর বয়সি অমৃত লাল চাকমা জানান, অধিকাংশ জুমচাষি দুই পদ্ধতি ব্যবহার করে জুমের জায়গা ঠিক করেন। একটি হচ্ছে- স্বপ্নের মাধ্যমে।
অন্যটি হচ্ছে- জুমে যে ধান বপন করা হবে সেই ধানের বীজ থেকে পাঁচ বা সাতটি চাল বের করে নতুন বাঁশের চোঙায় ভরে জুমের একটি গোপন জায়গায় রেখে এক দিন আগে জুমচাষি নিয়ত করে বলেন- যদি জায়গা ভালো হয় তাহলে চালগুলো যেন ঠিক জায়গায় থাকে, আর জায়গা খারাপ হলে চালগুলো যেন না থাকে।