লেখক -
মোহাম্মদ শাহী নেওয়াজ
উপ-পরিচালক
সমাজ সেবা অধিদফতর
জেলা সমাজ সেবা কার্যালয়, নোয়াখালী।
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সম্প্রতি দারিদ্র মানচিত্র প্রকাশ করেছে। বিবিএস প্রকাশিত প্রতিবেদনে সমগ্র দেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতি উপস্থাপিত হয়েছে। এ প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়েছে দেশের বর্তমান দারিদ্র্যের হার। এ প্রতিবেদন মতে, দেশের বর্তমান দারিদ্র্যের হার ১৮.৭ শতাংশ। যাছিল ২০১৬ সালে ২৪.৩ শতাংশ। অপরদিকে অতি দরিদ্র্যেরহার ৫.৬ শতাংশ যা ছিল ২০১৬ সালে ১২.৯ শতাংশ। সুতরাং দেশের সামগ্রিক দারিদ্র্যের হার উন্নীত হয়েছে। পরিবর্তন ঘটেছে আঞ্চলিক দারিদ্রতার উন্নয়নে। মঙ্গাপীড়িত রংপুর বিভাগে দারিদ্র্য হারের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। এ হার বর্তমানে ২৮.৮ শতাংশ যা ছিল ২০১৬ সালে ৪৭.২ শতাংশ। আবার শস্যভান্ডার খ্যাত বরিশাল বিভাগের বর্তমান দারিদ্র্যের হার ২৬.৯ শতাংশ যা অপরিবর্তীত। সরকারের বিবিধ আয় বর্ধনমূলক উদ্যোগ ও কর্মসূচির কারণে দেশের বর্তমান দারিদ্র্যের উন্নীত অবস্থান। একটি সুখী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ আমাদের স্বপ্ন। এ স্বপ্ন পুরণে গ্রহণ করতে হবে আদর্শ উন্নয়ন পরিকল্পনা ও কর্মসূচি।
দারিদ্র্য বিশে^র উন্নয়নশীল দেশে বিদ্যমান সামাজিক সমস্যা সমূহের মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশে দারিদ্র্য একটি অন্যতম সমস্যা। এ সমস্যার সাথে জড়িয়ে আছে অন্যান্য সমস্যার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতা। ১৭৭৬ সালে এডাম স্মিত তার An Inquiry into the Nature and Causes of the Wealth of Nations গ্রন্থে দারিদ্র্য বলতে ব্যক্তির ন্যূনতম প্রয়োজন পূরণ করার অক্ষমতাকে বুঝিয়েছেন। যে অবস্থায় মানুষ তার স্বাভাবিক জীবনমান বজায় রাখতে অক্ষম হয়। দারিদ্র্য একটি সমাজের মানুষের আর্থ-সামাজিক রূপ। এ অবস্থায় মানুষ ন্যূনতম শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক প্রয়োজন সমূহ পূরণে ব্যর্থ। দারিদ্র্যের কারণে ভিক্ষাবৃত্তি, ক্ষুধা, বাল্য বিবাহ, ছিনতাই, চুরি-ডাকাতি, বেকারত্ব সহ প্রভৃতি সামাজিক অপরাধের উৎপত্তি। দারিদ্র্যতা দেশের মানুষের মাথাপিছু আয়, মাথাপিছু খাদ্যগ্রহণ, পুষ্টি স্তর, বাসস্থান মান, চিকিৎসা সুবিধা, শিক্ষা স্তর ও সাংস্কৃতিক উৎকর্ষতা হ্রাস করে। ব্যক্তির দারিদ্রতা সামাজিক মর্যাদা ও সামাজিক নিরাপত্তার জন্য হুমকী।
বাংলাদেশ দারিদ্রের হার বিবেচনা করা হয় দৈনিক খাদ্য গ্রহণের মাপকাঠিতে। বিবিএস খানা আয় ও ব্যয় জরিপ পরিচালনায় দৈনিক মাথাপিছু ক্যালরী গ্রহণের মাপকাঠিতে দারিদ্র্যের হার নির্ধারণ করে। এ ক্ষেত্রে দারিদ্র্যতা বিন্যস্ত করা হয় দু’ভাবে। ক. যেসব ব্যক্তি দৈনিক ২১২২ কিলোক্যালরী শক্তি সম্পন্ন খাদ্য গ্রহণে অক্ষম এ শ্রেণির মানুষ অনুপেক্ষ (Relevant Poverty) দারিদ্র্য সীমায় অবস্থানকারী হিসেবে বিবেচিত। খ. যারা ১৮০৫ কিলোক্যালরী শক্তি সম্পন্ন খাদ্য সংগ্রহবা ক্রয় করতে অক্ষমতারা চরম দারিদ্র্য (Hard Core Poverty) সীমারনীচে অবস্থানকারী হিসেবে বিবেচিত। দারিদ্র সীমার নিচে বসবাসকারী মানুষগুলো মৌলিক-মানবিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ। বৃহত্তর দৃষ্ঠিতে অর্থনীতিবিদগণ দারিদ্র্যতার দু’টি মাত্রা চিহ্নিত করেছেন। যথা: আয় দারিদ্র: ব্যক্তির নূন্যতম শক্তিসম্পন্ন খাদ্য ক্রয়ের অক্ষমতা। এ ক্ষেত্রে বিশ^ ব্যাংক নির্ধারণ করেছে যে ব্যক্তি দৈনিক ১.২৫ ডলার উপার্যনে অক্ষম। মানব দারিদ্র্য: জনসংখ্যার যে অংশ স্বাস্থ্য, পুষ্টি, প্রজনন ও শিক্ষার ন্যূনতম সূচক অর্জনে ব্যর্থ, তারা মানব দারিদ্র্যের শিকার।
সর্বশেষ শুমারী অনুযায়ী দেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৭ কোটি (প্রায়)। এ হিসাবে দেশে বর্তমানে ৩.৪৬ কোটি (প্রায়) মানুষ দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাস করছে। সম্প্রতি দারিদ্র্যের আমরা বিবিধ তথ্য চিত্র সংবাদ মাধ্যমে দেখতে পাচ্ছি। যেমন: নি¤œ আয়ের মানুষ কর্মহীন, আয়-রোজগার নেই,খাদ্য সংকটে ভুগছে, সঞ্চয় ভেঙ্গে সংসার চলছে, ঋণ করে পরিবার চলছে, সন্তানদের পড়াশুনা বন্ধ ইত্যাদি। দেশের দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাসকারী মানুষকারা, কীতাদের পরিচয় ? তারা হচ্ছে সমাজের অসহায়, অবহেলিত, অনগ্রসর ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। এসব সুবিধাবঞ্চিত মানুষ হচ্ছে : প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, অবহেলিত প্রবীণ, দরিদ্র্য প্রবীণ, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, দলিত ও হরিজন শ্রেণি, হিজড়া, বেদে, অনগ্রসর জনগোষ্ঠীসহ বিবিধ প্রান্তিক মানুষ। এ মানুষগুলো চরম দারিদ্র্য কবলিত। ন্যূনতম নাগরিক অধিকার ও মানবিক মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকা তাদের জন্য দায়। খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, চিকিৎসা, আবাসন, বিশুদ্ধ পানি, পয়নিষ্কাশন, যৌতুক, বাল্যবিবাহ, দৈনিক মজুরী, মাথাপিছু আয় ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণসহ প্রত্যেক সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সূচকে তারা পিঁছিয়ে। তারা দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রার সাথে তাল মিলাতে অক্ষম।
বৈষম্যহীন ও ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে আমাদের স্বাধীনতা। স্বাধীনতা পরবর্তী দেশের দারিদ্র্যের হার ছিল প্রায় ৮০ শতাংশ। স্বাধীনতাত্তোর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের প্রধানমন্ত্রী ও পরিকল্পনা কমিশনের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। দারিদ্র্যে নিরসনের লক্ষ্যে তাঁর নেতৃত্বে প্রথম পঞ্চবার্ষিক (১৯৭৩-১৯৭৭) পরিকল্পনায় Pilot project for extended rural social upliftment শীর্ষক একটি পাইলটিং প্রকল্প গৃহীত হয়। এ প্রকল্পে ৯০ (নব্বই) টাকা সংস্থান রাখা হয়েছিল। তৎপ্রেক্ষিতে সমাজসেবা অধিদপ্তর ১৯৭৪ সালে ‘পল্লী সমাজ সেবা কার্যক্রম (জঝঝ)’ নামক একটি কর্মসূচি তৎকালীন ১৯ জেলার ১৯ উপজেলায় পরীক্ষামূলক ভাবে চালু করে। যাহা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে পরিচালিত প্রথম ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম। বর্তমানে এ অধিদপ্তর দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য দেশব্যপি পল্লী সমাজ সেবা কার্যক্রম (RSS), পল্লী মাতৃকেন্দ্র (RSS), আশ্রয়নে ক্ষুদ্রঋণ এবং প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। আরএসএসএর আওতায় এ পর্যন্ত ৯ লক্ষ ৬৯ হাজার স্কীমের বিপরীতে ক্ষুদ্রঋণ মঞ্জুর করা হয়েছে, যার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উপকার ভোগীপ্রায় ৩৫ লক্ষ পরিবার। গ্রামীণ মহিলাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ‘পল্লী মাতৃ কেন্দ্র কার্যক্রম (RMC)’ কার্যক্রমের আওতায় মোট উপকারভোগী ৬ লক্ষ ৫৭ হাজার নারী। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দারিদ্র্য বিমোচনে ‘দগ্ধ ও প্রতিবন্ধী পুনর্বাসন কার্যক্রম ’কার্যক্রমের বিপরীতে ইস্যূকৃত ঋণ সংখ্যা ১ লক্ষ ৮৬৫টি। তাছাড়া বিভিন্ন সরকারী দপ্তর, ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সমগ্র দেশে ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। যার মধ্যে অন্যতম ব্রাক, আশা, ইপসা, প্রশিকা, এসো গড়ি সংস্থা ও স্বনির্ভর বাংলাদেশ সহ বিবিধ নিবন্ধিত সংস্থা।
সরকারের বিবিধ জনবান্ধব উদ্যোগে সার্বিক দারিদ্র্য ক্রমান্নয়ে হ্রাস পাচ্ছে। কিন্তু মানুষের আয় বৈষম্য বেড়েছে বহুগুণে। সর্বাধিক আয় বৈষম্যের শিকার দেশের প্রান্তিক মানুষগুলো। সমাজসেবা অধিদপ্তর দেশের অন্যতম জাতি গঠনমূলক প্রতিষ্ঠান। এ দপ্তরের অন্যতম লক্ষ্য সুবিধা বঞ্চিত ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর সামাজিক সুরক্ষা সুনিশ্চিত করণ। এ লক্ষ্যে সামাজিক ন্যায় বিচার ও সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করা এবং প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর সম অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এ দপ্তর কাজ করছে। এ দপ্তর সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় দেশব্যপি বয়স্ক ভাতা, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতাভাতা এবং প্রতিবন্ধী ভাতা প্রদান করা হচ্ছে। দেশের প্রান্তীক মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা ও জীবনমান উন্নয়নের জন্য ও বিবিধ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। বিশেষত হিজড়া, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষভাতা, শিক্ষা উপবৃত্তি এবং প্রশিক্ষণ কার্যক্রম অন্যতম। সরকার এ প্রকল্প সমূহের অন্যতম লক্ষ্য দেশের অসহায় ও প্রান্তিক মানুষের নুন্যতম জীবনমান বজায় রাখা। যার মাধ্যমে দেশের দারিদ্র বিমোচন, আয় বৈষম্য হ্রাস এবং সম্পদের সুসমবন্টন সুনিশ্চিত করা হচ্ছে।
দেশের দারিদ্র্য বিমোচন ও আয়বৈষম্য নিরসনে সকলকে অধিক সচেতন হওয়া প্রয়োজন। সাম্প্রতিক প্রকাশিত ‘গৃহস্থালী খানাআয়-ব্যয় জরিপ-২০২২’ মতে দেখা যায় দেশের উপরে অবস্থানকারী ১০ শতাংশ মানুষ মোট আয়ের ৪১ শতাংশ আয় করে। অন্যদিকে নিচের ১০ শতাংশ মানুষের হাতে আছে মোট আয়ের মাত্র ১.৩১ শতাংশ। প্রতি বছর বাজেটের আকার বাড়ছে এবং সরকারগহণ করছেন নতুন নতুন উদ্যোগ। কিন্তু দেশের আয়বৈষম্য উদ্বেগজনক অবস্থায় আছে। বিশ^ব্যপি আয়বৈষম্য পরিমাপ করা হয় গিনিসহ গপদ্ধতিতে। ২০২২ সালের শেষে গনিসহগ বেড়ে ৪৯৯ দাঁড়িয়েছে। আর এক পয়েন্ট বাড়লে, অর্থাৎ গিনিসহগ ৫০০ হলে বাংলাদেশ উচ্চ আয় বৈষম্যের দেশে পরিণত হবে। বহুজাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ এক্স এর প্রতিবেদন মতে বিশে^ ধনীর সংখ্যাবৃদ্ধির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান অন্যতম। বর্তমানে এ বৃদ্ধিরহার ১৪.৩ শতাংশ। দেশে ৫ শত কোটি (৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) সম্পদের অধিকারী ব্যক্তির সংখ্যা ২১,৩৯৯ জন। বৈধ ভাবে ধনীর হার বৃদ্ধি ইতিবাচক। কিন্তু ধনিক শ্রেণিতাদের উপার্জিত সম্পদ উৎপাদনশীল খাতে ব্যয় করছেনা। তাদের অর্জিত সম্পদ ব্যয় হচ্ছে ব্যক্তিগত স্থায়ী সম্পদ সংগ্রহে নতুবা অর্জিত আয় কৌশলে লুকিয়ে রাখা হচ্ছে। দেশের দারিদ্র্য বিমোচন ও আয় বৈষম্য নিরসনে ধনিক শ্রেণির মনোভাব হতে হবে ইতিবাচক। বিত্তশালীগণ যদি ধর্মীয় চেতনা, মানব কল্যাণ ও মানবতা বোধের পরিবর্তে অতি ধনিক হওয়ার তাড়নায় মগ্ন থাকে, তা দেশের জন্য উদ্বেগজনক। একটি বৈষম্যহীন ও আদর্শিক সমাজ প্রতিষ্ঠা হোক আমাদের অঙ্গীকার।
প্রধান সম্পাদক : বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রিয়দর্শী বড়ুয়া, প্রকাশক : প্রদীপ কান্তি দাশ, সম্পাদক : মো. নুরুল করিম আরমান, আইন বিষয়ক উপদেষ্ঠা : এ্যডভোকেট ফয়সাল আজিজ।
সম্পাদকীয় কার্ষালয় : প্রেসক্লাব ভবন (দ্বিতীয় তলা), প্রধান সড়ক, লামা পৌরসভা, বান্দরবান
ই-মেইল paharerkatha@gmail.com, মোবাইল: ০১৭৫০৪৪৪৯৯৬/০১৮১৪৮৪৫০৭৩
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত